অনেক মধ্যরাত্রিতে যখন অতলস্পর্শী ক্লান্তি আমাকে আচ্ছন্ন করে কেলে তখন মনে হয় আমার হাত ধরে টুকটুক পা ফেলে পরী হাঁটছে।
যে-জান্তব পশুশক্তির ভয়ে পরী ছোট ছোট পা ফেলে ত্ৰিশ মাইল হেঁটে গেছে, আমার সমস্ত ক্ষমতা ও শক্তি তার বিরুদ্ধে। আমি রাজনীতি বুঝি না। স্বাধীনতাটাধীনতা নিয়ে সে-রকম মাথাও ঘামাই না। শুধু বুঝি, ওদের শিক্ষা দিতে হবে। জাফর প্রায়ই বলে, হুমায়ূন ভাই ইচ্ছে করে চোখ বুজে থাকেন। হয়তো থাকি। তাতে ক্ষতি কিছু নেই। আমি কি আমার দায়িত্ব পালন করি নি, জাফর?
মনে মনে এই কথা বলে আমি একটু হাসলাম। জাফরের সঙ্গে আজ ভোরে আমার খানিকটা মন কষাকষি হয়েছে। সে চাচ্ছিল। আজকের এই এ্যাসাইনমেন্টের নেতৃত্ব যেন আসলাম পায়। জানি না। এর পেছনের সত্যিকার কারণটি কি? দলপতির পুতি আস্থা না থাকা বড়ো বিপজ্জনক। মুশকিল হচ্ছে-আমরা রেগুলার আর্মির লোকজন নই। আনুগত্য হল একটা অভ্যাস, যা দীর্ঘদিনের টেনিং-এর ফলে মজ্জাগত হয়। রেগুলার আর্মির এক জন অফিসারের অনুচিত হুকুমও সেপাইরা বিনা দ্বিধায় মেনে নেবে। কিন্তু আমার হুকুম নিয়ে তারা চিন্তা-ভাবনা করবে। পছন্দ না হলে কৈফিয়ত পর্যন্ত তলব করে বসবে। কাজেই আমার প্রথম কাজ ছিল দলের লোকের আস্থা অর্জন করা। বুঝিয়ে দেওয়া যে, আমার উপর নির্ভর করা যেতে পারে। কিন্তু আমি তা পারি নি। কাপুরুষ হিসেবে মার্কা-মারা হয়ে গেছি।
যদিও তারা সব সময়ই হুমায়ূন ভাই, হুমায়ূন ভাই করে এবং সবাই হয়তো একটু শ্রদ্ধাও করে, কিন্তু সে-শ্রদ্ধা এক জন যোদ্ধা হিসেবে নয়।
আমার প্রথম ভুল হল আমি হাজী সাহেবের মৃত্যুতে সায় দিতে পারি নি। লোকটার নৃশংসতা সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। মৃত্যুদণ্ড যে তার প্রাপ্য শাস্তি, এতেও ভুল নেই। তবু আমার মায়া লাগল। ষাটের উপর বয়স হয়েছে। মরবার সময় তো এমনিতেই হল। তবু বাঁচবার কী আগ্রহ! সে আমাদের বিশ হাজার টাকা দিতে চাইল। শুনে আমার ইচ্ছে হল, একটা প্রচণ্ড চড় কষিয়ে দি। কিন্তু আমি শান্ত গলায় বললাম–জাফর, হাজী সাহেবকে ক্যাম্পে নিয়ে চল। জাফর চোখ লাল করে তাকাল আমার দিকে। থেমে থেমে বলল, একে কুকুরের মতো গুলী করে মারব। হাজী সাহেব চিৎকার করে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন। এই তিনিই যখন মিলিটারি দিয়ে লোকজন মারিয়েছেন, তখন সেই লোকগুলিও নিশ্চয়ই আল্লাহকে ডেকেছিল। আল্লাহ তাদের যেমন রক্ষা করেন নি-হাজী সাহেবের বেলায়ও তাই হল। হাজী সাহেব অপ্রকৃতিস্থ চোখে তাকিয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি দেখতে লাগলেন। জাফর এক সময় বলল, তওবা-টওবা যা করবার করে নেন। দোওয়াকালাম পড়েন। হাজী সাহেব। আর তখন হাজী সাহেব চিৎকার করে তাঁর মাকে ডাকতে লাগলেন।
ও মাইজি গো, ও মাইজি গো। কতকাল আগে হয়তো এই মহিলা মারা গেছেন। সেই মহিলাটিকে হাজী সাহেব হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন। আজ রাইফেলের কালো নলের সামনে দাঁড়িয়ে আবার তাঁর কথা মনে পড়ল। আল্লাহর নাম চাপা পড়ে গেল। এক অখ্যাত গ্রাম্য মহিলা এসে দাঁড়ালেন সেখানে।
আমি পিছিয়ে পড়েছিলাম। আনিস বলল, রাইফেলটা আমার কাছে দিন, হুমায়ূন ভাই। আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। জাফর এবং হাসান আলি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের উঁচু সড়কে উঠে পড়েছে। বেশ কিছু দূর এগিয়ে রয়েছে তারা। দ্রুত পা চালাচ্ছি। উঁচু সড়কে উঠে পড়তে পারলে হাঁটা অনেক সহজ হবে। পরিষ্কার রাস্তা, জল-কাদা নেই। এখান থেকেই আমরা সরাসরি গ্রামের ভেতর দিয়ে চলব। আমি উঠে আসতেই মজিদ বলল, জোঁক ধরেছে নাকি দেখেন ভালো করে। আনিসের পা থেকে তিনটি জোঁক সরান হয়েছে। একটা রক্ত খেয়ে একেবারে কোলবালিশ হয়ে গিয়েছিল।
হাসান আলি টর্চ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পায়ে উপর ফেলতে লাগল। না, জোঁকটোক নেই। তবে শামুকে লেগে পা অল্প কেটেছে। জ্বালা করছে। মজিদ বলল, একটু রেস্ট নিই, মালগাড়ির মতো টায়ার্ড হয়ে গেছি। দেখি আনিস, একটা সিগারেট।
আনিস সিগারেটের প্যাকেট খুলল। হাসান আলিও হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিল। সে আমাদের সামনে খাবে না, তাই একটু সরে গেল। আনিস বলল, আপনিও নিন একটা হুমায়ূন ভাই। সিগারেট টানলে আমার জিভ জ্বালা করে। নিকোটিন জিভের উপর জমা হয় হয়তো। তবুনিলাম একটা। আমাদের এখন সাহস দরকার। আগুনের স্পর্শ সে সাহস দেবে হয়তো। দেয়াশলাই সবে জ্বলিয়েছি, অমনি বাঁশবনের অন্ধকার থেকে কুকুর ডাকতে লাগল। তার পরপরই একটি ভয়ার্ত, চিৎকার শোনা গেল, কোডা, ঐখানে কেডা? কতা কয় না লোকটা! কেডা গো?
হারিকেন হাতে দু-চার জন মানুষও বেরিয়ে এল। ও রমিজের বাপ, ও রমিজের বাপ বলে চিকন কণ্ঠে তুমুল চিৎকার শুরু করল একটি মেয়ে। সবাই বড়ো ভয় পেয়েছে। এর মধ্যে অল্পবয়সী একটি শিশু তারস্বরে কাঁদতে শুরু করল। মজিদের উচ্চকণ্ঠ শোনা গেল, ভয় নাই, আমরা।
তোমরা কেডা?
আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের চারপাশে ভিড় জমে উঠল। হারিকেন হাতে ভয়কাতর লোকগুলি ঘিরে দাঁড়াল আমাদেম। অস্পষ্ট আলোয় রাইফেলের কালো নল চিকচিক করছে। আমরা তাদের সামনে অষ্টম আশ্চর্যের মতো দাঁড়িয়ে আছি।
মিয়া সাবরা এটু পান তামুক খাইবেন?
না। আপনারা এত রাতেও জাগা, কারণ কি?
বড়ো ডাকাইতের উপদ্রব। ঘুমাইতাম পারি না। জাইগা বইয়া থাকি।
এই দিকে মিলিটারি আসছিল?