হুমায়ূন ভাই দেখি উত্তেজিত হয়ে নেমে আসছেন। ছাদ থেকে। কী ব্যাপার, মোটর লঞ্চের আলো দেখা যায় নাকি? আনিস চা ছাকতে ছাকতে বলল, কী ব্যাপার হুমায়ূন ভাই?
কিছু না। অনেকগুলি উল্কাপাত হল। একটা তো প্রকাণ্ড!
উল্কাপাত শুনেছি খুব অশুভ ব্যাপার। আমার মা বলতেন অন্য কথা। তিনি নাকি কোথায় শুনেছেন উল্কাপাতের সময় কেউ যদি তার গোপন ইচ্ছাটি সশব্দে বলে ফেলে, তাহলে সে ইচ্ছা পূৰ্ণ হয়। এক মজার কাণ্ড হল এক দিন। জ্যামিতি বই হারিয়ে ফেলেছি। সন্ধ্যাবেল বসে আছি বারান্দায়। আকাশের দিকে চোখ। উল্কাপাত হতে দেখলেই বলব, জ্যামিতি বইটা যেন পাই।
কোথায় গেল সে-সব দিন। মায়ের মুখ আর মনেই পড়ে না। এক দিন কথায় কথায় অবনী স্যার আমাদের ক্লাসে বললেন, যে-সব ছেলের মনে মায়ের চেহারার কোনো স্মৃতি নেই, তারা হল সবচে অভাগা। আমি চোখ বুজে ক্লাসের ভেতরেই স্বায়ের চেহারা মনে আনতে চেষ্টা করলাম। একটুও মনে পড়ল না। সেই যে পড়ল না, পড়লাই না। এখনো পড়ে না। স্বপ্নেও যে এক-আধা দিন দেখব, সে উপায়ও নেই। আমার ঘুম এমন গাঢ়-স্বপ্নটপ্লের বালাই নেই। দূর ছাই!
নেমে পড়েছে সবাই। ওরে বাবা রে, কী কাদা! কোমর পর্যন্ত তলিয়ে যাবার দাখিল! হাসান আলি আরেকটু হলে গুলীর বাক্স নিয়ে নদীতে পড়ত। লাইটমেশিনগানটা সবাই মিলে চাপিয়েছে আমার কাঁধে। নামেই লাইট, আসলে মেলা ওজন। আকাশে গুডগুড মেঘ ডাকছে আবার। বৃষ্টি নামলেই গেছি।–মজিদের ভাষায় একেবারে পাটেটো চিপস হয়ে যাব।
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ
আজ সারাটা দিন আমার মন খারাপ ছিল; এখন মধ্যরাত্রি, ছপছপ শব্দে কাদা-ভরা রাস্তায় হাঁটছি। মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। এত দিনেও হাঁটার অভ্যেস হল না। আনিস এবং মজিদ কত নির্বিকার ভঙ্গিতেই না পা ফেলছে। এতটুকু ক্লান্ত না হয়েও তারা দশ মাইল হেটে পার হবে; বিপদ হবে আমাকে নিয়ে। জাফরও হাঁটতে পারে না। তবে আমার মতো এত সহজে ক্লান্তও হয় না। সমস্ত দলটির মধ্যে আমি সবচেয়ে দুর্বল। শরীরের দিক দিয়ে তো বটেই, মনের দিক থেকেও। তবুও আজকের জন্যে আমিই কমাণ্ডার। কমাণ্ডার শব্দটা শুনতে বড়ো গেয়ো। অধিপতি বা দলপতি হলে মানাত। না, আমি তেমন বাংলাগ্রেমিক নই। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ইংরেজি সাইন-বোর্ড ভাঙার ব্যাপার আমার কাছে খুব হাস্যকর মনে হয়। যে-কোনো জিনিসের বাড়াবাড়ি আমাকে পীড়া দেয়। আর সে জন্যেই যুদ্ধে এসেছি।
এক মাইলও হাঁটি নি, এর মধ্যেই পা ভারি হয়ে এসেছে। কী মুশকিল! নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। শার্ট ভিজে গিয়েছে ঘামে।
ঢাকা থেকে ভাই, বোন, বাবা, মা সবাইকে নিয়ে একনাগাড়ে ত্রিশ মাইল হেঁটে পৌঁছেছিলাম মির্জাপুর। কী কষ্ট, কী কষ্ট! নিজের জন্যে কিছু নয়। জরী ও পরীর দিকে তাকান যাচ্ছিল না। পরীর ফর্স মুখ নীল বর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে অনেকেই হাঁটছিলেন। কাফেলার মতো ব্যাপার। এক-এক বার হুস করে সুখী মানুষেরা গাড়ি নিয়ে উড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। এমন হৃদয়বান কাউকে কি পাওয়া যাবে, যে আমাদের একটুখানি লিফট্ দেবে! দুঃসময়ে সবাই হৃদয়হীন হয়ে পড়ে। আমাদের সঙ্গে এক জন গৰ্ভবতী মহিলা ক্লান্ত পায়ে হাঁটছিলেন। তিনি ক্রমাগতই পিছিয়ে পড়ছিলেন। ভদ্রমহিলাস্ত্র স্বামী তা দেখে রেগে আগুন। রাগী গলায় বললেন, টুকুস টুকুস করে হাঁটছ যে? তোমার জন্যে আমি মরব নাকি? এই দীর্ঘ পথে কত কথাবার্তা হয়েছে কত জনের মধ্যে। কত অশ্রুবর্ষণ, কত তামাশা।–কিছুই আজ আর মনে নেই, কিন্তু ঐ স্বামী বেচারার কথাগুলি এখনো কাঁটার মত বুকে বিধে আছে। গৰ্ভবতী মহিলার শোকাহত চোখ এখনো চোখে ভাসে।
রাস্তাতেই পরীর হুঁ-হু করে জ্বর উঠে গেল। আমি বললাম, কোলে উঠবি পরী? পরীর কী লজ্জা। ক্লাস টেনে পড়ে মেয়ে, দাদার কোলে উঠবে কি? পরী অপ্রকৃতিস্থের মতো পা ফেলে হাঁটতেই থাকল। তার হাত ধরে–ধরে চলছি আমি। ঘামে ভেজা গরম হাত, আর কী তুলতুলে নরম। পরীর হাতটা যে এত নরম, তা আগে কখনো জানি নি। জরীর হাত ভীষণ খসখসে, অনেকটা পুরুষালি। কিন্তু পরীর হাত কী নরম, কী নরম।
মীর্জাপুরের কাছাকাছি এসেই পরী নেতিয়ে পড়ল। জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে। বমি করতে লাগল ঘনঘন। বাবা একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়লেন। কোথায় ডাক্তার কোথায় কি? এর মধ্যে গুজব রটে গিয়েছে, ঢাকা থেকে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক দল জোয়ানকে মিলিটারিরা এই দিকেই তাড়া করে আনছে। চারদিকে ছুটোছুটি, চিৎকার, আতঙ্ক। মা এবং জরী ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। বাবা যাকেই পাচ্ছেন তাকেই জিজ্ঞেস করছেন, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি ডাক্তার?
ডাক্তার পাওয়া যায় নি, কিন্তু এক ভদ্রলোক দয়াপরবশ হয়ে তাঁর ট্রাকে আমাদের টাঙ্গাইল পৌঁছে দিলেন। টাঙ্গাইল পৌঁছালাম শুক্রবার সন্ধ্যায়। পরী মারা গেল রোববার রাতে। সন্ধ্যাবেলাতে কথা বলল ভালো মানুষের মতো। বারবার বলল, কোনো মতে দাদার বাড়ি পৌঁছতে পারলে আর ভয় নেই। তাই না বাবা?
পরীর মৃত্যু তো কিছুই নয়। কত কুৎসিত মৃত্যু হয়েছে চারপাশে। মৃত্যু এসেছে। সীমাহীন বীভৎসতার মধ্যে। কত অসংখ্য অসহায় মানুষ প্রিয়জনের এক ফোঁটা চোখের জল দেখে মরতে পারে নি। মরবার আগে তাদের কপালে কোনো স্নেহময় কোমল করম্পর্শ পড়ে নি।