এমনি হাসছি।
হঠাৎ হাসান আলি ভয়-পাওয়া গলায় বলল, লঞ্চের আওয়াজ আসে।
আমার বুক ধ্বক করে উঠল। তার মানে হচ্ছে, আমিও ভয় পাচ্ছি। সেই ভয়, যা যুক্তি-তর্ক মানে না, হঠাৎ করে এসে আমাদের অভিভূত করে ফেলে। হুমায়ূন ভাই বললেন, নৌকা ভেড়াও হাসান আলি।
ছপ ছপ দাঁড় পড়ছে। আনিস এবং মজিদ দুজনেই দুটি বৈঠা তুলে নিয়েছে। আমরা এখনো লঞ্চের শব্দ শুনি নি, তবে হাসান আলি যখন শুনেছে, তখন আর ভুল নেই।
সাড়াশব্দ শুনে মজিদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে হকচকিয়ে বলল, কী হয়েছে?
আমি বললাম মজিদ, তোমার শ্বশুর সাহেব আসছেন, উঠে বস।
কে শ্বশুর, কার কথা বলছ?
হুমায়ূন ভাই বিরক্ত হয়ে বললেন, তামাশা রাখ, জাফর। হাসান আলি এখনো শুনতে পাচ্ছ?
হাসান আলি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর হাসিমুখে বলল, না, আর শবদ পাই না।
খবর পাওয়া গেছে, এই অঞ্চলে কিছু দিন ধরেই একটি স্পীডবোট ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্ষার পানিতে খালবিলগুলি যেই একটু ভরাট হয়েছে, আমনি নামিয়েছে স্পীডবোট। নৌকা করে আমাদের আরো এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছি না। অবশ্যি রামদিয়া পর্যন্ত কী ভাবে যাব, তা ঠিক করবে। হাসান আলি। আমাদের রাত দুটোর আগে রামদিয়া পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে তার। হাসান আলি বলল, হাটাপথে যাওন লাগিব। অল্প কিছু প্যাক-কাদা আছে, কিন্তু উপায় সুর কী!
মজিদ বলল, কিয় মাইল পথ?
আট-নয় মাইল।
আমার শেয়ালের মতো খিদে লেগেছে, হাঁটা মুশকিল।
আনিস বলল, শেয়ালের মতো খিদেটা কী রকম জিনিস?
অর্থাৎ মুরগি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
মজিদ হোহো করে হেসে ফেলল।
নৌকা থেকে বেরিয়ে এসে দেখি চাঁদ ড়ুবে গেছে। কিন্তু খুব পরিষ্কার আকাশ। অসংখ্য তারা ঝিকমিক করছে। নক্ষত্রের আলোয় আবছাভাবে সব নজরে আসে। আনিস বলল, দশ মাইল হাঁটা সহজ কর্ম না। হুমায়ূন ভাই অনুমতি দিলে আরেক দফা চা হোক, কী বলেন?
বেশ তো, চা চড়াও।
হাসান আলি, আদা আছে তোমার কাছে? একটু আদা–চা হোক, গলাটা খুসখুসি করছে। জাফর, তুমিও খাবে নাকি হাফ কাপ?
না, চা খেলে ঘুম হয় না। আমার।
ঘুমুবার অবসরটা পাচ্ছ কই?
ঘুমুবার অবসর সত্যি নেই। তবু অভ্যেসটা তো আছে। হুমায়ূন ভাই দেখি নৌকার ছাদে উঠে বসেছেন। গুনগুন করছেন নিজ মনে। কোন গানটা টিউন করছেন, কে জানে। ঠিক ধরতে পারছি না। আহে, চমৎকার লাগছে। আড়াল থেকে শুনতে বেশ লাগে। অনুরোধ করতে গেলেই সেরেছে। গাইবেন না কিছুতেই। তাঁর কাছ থেকে গান শোনবার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, এমন একটা ভাব দেখান যে, তিনি কী করছেন তার দিকে তোমার একটুও নজর নেই। হ্যাঁ, এইবার গান শোনা যাচ্ছে–
শ্যামল ছায়ায় নাই-বা গেলে
না না না নাই-বা গেলে
না না বলবার সময় বেশ কায়দা করে গলা ভাঙছে তো! শুনতে খুব ভালো লাগছে। শান্ত হয়ে আছে বিল। বিলের পানি দেখাচ্ছে কালো আয়নার মতো। কালো আয়নাটা আবার কী? কি জানি কী। তবে কালো আয়নার কথা মনে হয়। আকাশে অসংখ্যা তারা উঠেছে। তারাগুলির জলে ছায়া পড়া উচিত। কী আশ্চর্য, ছায়া পড়ছে না তো! আকাশে যখন খুব তারা ওঠে, তখন নাকি দেশে আকাল আসে। মজিদ বলল, সাংঘাতিক খিদে লেগেছে। খালি পেটে চা খাওয়াটা কি ঠিক?
হুমায়ূন ভাই গান থামিয়ে বললেন, খালি পেটে চা না খেতে চাইলে গোটা দুই ডিগবাজি খেয়ে নাও মজিদ। এ ছাড়া আর কোনো খাদ্যদ্রব্য নেই।
আনিস আবার এই শুনেই ফ্যাফ্যা করে হাসতে শুরু করেছে। এর মধ্যে এত হাসির কী আছে? হুমায়ূন ভাই আবার গুনগুন শুরু করেছেন। তাঁর বোধহয় মন –টন বিশেষ ভালো নেই। কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন না। এমনি তিনি অবশ্যি শুধু! ফুর্তিবাজ ছেলে। আমার উপর রাগ করেছেন কি?
আজ ভোরে তাঁর সঙ্গে আমার খানিকটা মন কষাকষি হয়েছে। বিস্তু আমি অন্যায় কিছু বলি নি। শুধু বলেছি, মেথিকান্দার এ অপারেশনের দায়িত্ব হুঁমায়ূন ভাইয়ের নিয়ে কাজ নেই। এতে কী মনে করেছেন তিনি? তাঁর প্রতি আস্থা মই আমার? তিনি ঠিকই মনে করেছেন। এমন দুর্বল লোকের এ-রকম, এ্যাসাইনমেন্টের নেতৃত্ব পাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু আমাদের সাব-সেক্টরে সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড কী মনে করে এটা করলেন কে জানে!
দালাল হাজী মারার ব্যাপারটাই দেখি না কেন। এই লোক কম করে হলেও গোটা ত্ৰিশেক মানুষ মারিয়েছে। হিন্দুদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে একাকার করেছে। মিলিটারি ক্যাপ্টেনের পিছে পিছে কুকুরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে। সে যখন হলদিয়ার বাজারে ধরা পড়ল আমাদের হাতে, আমি বললাম, গাছের সঙ্গে বেঁধে বেয়োনেট দিয়ে শেষ করে দি। গ্রামের লোকদের একটা শিক্ষা হোক, ভবিষ্যতে আর কেউ দালালী করবার সাহস পাবে না। হুমায়ূন ভাই মাথা নাড়েন। ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চান এ্যারেক্ট করে। পাগল নাকি! সেই শেষ পর্যন্ত গুলী করে মারতে হল। হুমায়ূন ভাই সেই দৃশ্যও দেখবেন না। তিনি নদীর পাড়ে চুপচাপ বসে রইলেন। আরে বাবা, তুমি তো মেয়েমানুষ নও। নাচতে নেমেছ, এখন আবার ঘোমটা কিসের? You have to be cruel, only to be kind—আবু ভাই বলতেন সব সময়। আহ, মানুষের মতো মানুষ ছিলেন আবু ভাই। আবু ভাইয়ের লাশ নিয়ে যখন আসল, তখন বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁর পায়ে চুমু খাই। আবু ভাইয়ের মতো মানুষগুলি এত অল্প আয়ু নিয়ে আসে কেন? যুদ্ধ শেষ হলে আবু ভাইয়ের মেয়েটিকে দেখতে যাব। তাকে কোলে নিয়ে বলব–। কী বলব তাকে?