এগারটা বেজে গেছে। দুটোর আগে রামদিয়া পৌঁছান অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। অবশ্যি তা নিয়ে কাউকে খুব চিন্তিতও মনে হচ্ছে না। আনিস দেখি আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। মজিদ লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। হাসান আলি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড় টানছে। আমি বললাম, হাসান আলি, দুটোর মধ্যে পৌঁছতে পারব তো?
হাসান আলি জবাব দিল না। বিশ্ৰী স্বভাব তার। কিছু জিজ্ঞেস করলে ভান করবে যেন শুনতে পায় নি। যখন মনে করবে। জবাব দেওয়া প্রয়োজন, তখনি জবাব দেবে, তার আগে নয়। আমি আবার বললাম, কী মনে হয়। হাসান আলি, দুটোর মধ্যে রামদিয়া পৌঁছব?
কোনো সাড়াশব্দ নেই। এই জাতীয় লোক নিয়ে চলাফেরা করা মুশকিল। আমি তো সহ্যও করতে পারি না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় দিই রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাথায় এক বাড়ি-হারামজাদা ছোটলোক! কিন্তু রাগ সামলাতে হয়। কারণ লোকটা দারুণ কাজের। এ অঞ্চলটা তার নিখাদপণে। নিকষ অন্ধকারে মাঝে মাঝে আমাদের এত সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে, মনে হয়েছে ব্যাটা বিড়ালের মতো অন্ধকারেও দেখতে পায়। খাটতে পারে যন্ত্রের মতো। সারা রাত নৌকা চালিয়ে কিছুমাত্র ক্লান্ত না হয়ে বিশ-ত্রিশ মাইল হেঁটে মেরে দিতে পারে। আবু ভাই হাসান আলির কথা উঠলেই বলতেন, দি জায়েন্ট।
কিন্তু এই এক তোষ, মুখ খুলবে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে শূন্যদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার নিজের কাজ করে যাবে। প্রথম প্রথম মনে হত হয়তো কানে কম শোনে। ও আল্লা, শেষে দেখি এক মাইল দূরের ঝিঝি পোকার ডাকটিও বুঝি তার কান এড়ায় না। কুড়ালখালির কাছে এক বার-আমাদের সমস্ত দলটি নৌকায় বসে! আবু ভাই সে-সময় বেঁচে। তিনি এক ন্যাংটো বাবার গল্প করছেন, আমরা স্বাই হো-হো করে হাসছি। এমন সময় হাসান আলি বলল, লঞ্চ আসতাছে, উঠেন সবাই পাড়ে উঠেন।
আমরা কান পেতে আছি। কোথায় কী-বাতাসের হুঁস হুঁস শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। আনিস বলল, যত সব বোগাস! তারপর কী কী হল? আবু ভাই ললেন, গল্প পরে হবে, এখন উঠে পড় দেখি; হাসান আলি যখন শব্দ শুনেছে, তখন আর ভুল নেই।
সেবার সত্যি সত্যি দুটি স্পীডবোট বাজারে এসে ভিড়েছিল। হাসান আলির কথা না শুনলে গোটা দলটো মারা পড়তাম।
আমার অবশ্যি সে রকম মৃত্যুভয় নেই। তবু কে আর বেঘোরে মরতে চায়? আমাদের মধ্যে মজিদের ভয়াটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি। কোনো অপারেশনে যাওয়ার আগে কুরআন শরীফ চুমু খাওয়া, নফল নামাজ পড়া, ডান পা আগে ফেলা–এক শ পদের ফ্যাকরা। গলায় ছোটখাটো ঢোলের আকারের এক তাবিজ। কোন পীর সাহেবের দেওয়া, যা সঙ্গে থাকলে অপঘাতে মরবার বিন্দুমাত্র আশঙ্কাও নেই। ভাবলেই হাসি পায়।
এ-রকম ছেলে দলে নেওয়া ঠিক নয়। এতে অন্যদের মনের বল কমে যায়। তবে হ্যাঁ, আমি এক শ বার স্বীকার করি, অপারেশন যখন শুরু হয় তখন মজিদের মাথা থাকে সবচেয়ে ঠাণ্ডা। এক তিল বেতাল নেই। আর এইম পেয়েছে কি, তিনটি ওলীর মধ্যে তার দুটি গুলী যে টার্গেটে লাগবে এ নিয়ে আমি হাজার টাকা বাজি রাখতে পারি। আমাদের টেনিং দেওয়াতেন ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার সুরুজ মিয়া। আমরা ডাকতাম বুডা ওস্তাদ। বুডা ওস্তাদ প্রায়ই বলতেন, মজিদ ভাইয়ের হাত সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দেব। আহু কী হাত–কী নিশানা, জিতা রাহ।
মজিদের মতো ছেলের এতটা ভয় থাকা কি ঠিক? মজিদ। যদি এ-রকম ভয় পায় তো আমরা কী করি? এক রাত্রে ঘুম ভেঙে দেখি সে হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি হতভম্ব। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে মজিদ?
কিছু হয় নাই।
খুব করে চেপে ধরায় বলল, সে স্বপ্নে দেখেছে এক বুড়ো লোক এসে তাকে বলছে–আব্দুল মজিদ, তোমার গলায় কি গুলী লেগেছে? এতেই কান্না। শুনে এমন রাগ ধরল। আমার। ছিঃ ছিঃ এ কী ছেলেমানুষী ব্যাপার! আমি অবশ্যি কাউকে বলি নি।
পরবর্তী এক সপ্তাহ সে কোথাও বেরল না। হেন-তেন কত অজুহাত। আসল কারণ জানি শুধু আমি। কত বোঝালাম–স্বপ্ন তো আর কিছুই নয়, অবচেতন নের চিন্তাই স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু মজিদের এক কথা।–তার সব স্বপ্ন নাকি ফলে যায়। এক বার নাকি সে স্বপ্নে দেখিছিল তার ছোট বোন পানি পানি করে চিৎকার করছে, আর সেই বোনটি নাকি ক দিন পরই অ্যাক্সিডিন্টে মারা গেছে। মরবার সময় পানি পানি করে অবিকল যেমন স্বপ্নে দেখেছিল। তেমনি ভঙ্গিতে চেঁচিয়েছে। কী অদ্ভুত যুক্তি!
মৃত্যুর জন্যে ভয় পাওয়াটা একটি ছেলেমানুষী ব্যাপার নয় কি? আমার তাই মনে হয়। যখন সত্যি সত্যি মৃত্যু তার শীতল হাত বাড়াবে, তখন কী করব জানি না, তবে খুব যে একটা বিচলিত হব, তাও মনে হয় না।
তা ছাড়া আমার মৃত্যুতে কারো কিছু আসবে–যাবে না। আমার জন্যে শোক করবার মতো প্রিয়জন কেউ নেশ। লীয়-স্বজনরা চোখের পানি ফেলবে, চেঁচিয়ে কাঁদবে, বন্ধু-বান্ধবরা মুখ কালে; করে বেড়াবে, তবেই না মরে সুখ।
শুনেছি বিলেতে নাকি অনেক ধনী বুড়োবুড়ি বিশেষ এক সংস্থার কাছে টাকা রেখে যায়। এইসব বুড়োবুড়ির কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। সেই বিশেষ সংস্থাটি বুড়োবুড়ির মৃত্যুর পর লোক ভাড়া করে আনে। অদ্ভুত ব্যবস্থা। সত্যি এ-রকম কিছু আছে, না। শুধুই গালগল্প? আমাদের দেশে এ-রকম থাকলে আমিও আগেভাগেই লাক ভাড়া করে আনতাম। তারা সুর করে কাঁদতে বসত–ও জাফর, জাফর র, তুমি কোথায় গেলা রে? এই কথা মনে উঠতেই দেখি হাসি পাচ্ছে। আমি সশব্দে হেসে উঠলাম। আনিস বলল, কী হয়েছে, এত হাসি–