সবাই হেসে উঠল হো-হো করে। আমার বেশ মজা লাগছে। আনিস বলল, এক কাজ করি, জাফরের কানের কাছে মুখ নিয়ে মিলিটারি মিলিটারি বলে চিৎকার করে উঠি। দেখি জাফর কী করে। মজিদ বলল, দাঁড়া, চায়ের পানি ফুটুক, তারপর।
ওদের কথাবার্তা এমন ছেলেমানুষী, হাসি লাগে আমার। কী মনে করেছে। ওরা। মিলিটারি মিলিটারি শুনে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে আমি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ব নাকি? সরি, এতটা ভয় আমার নেই। আচমকা শুনলে একটু দিশাহারা হব হয়তো, এর বেশি না। সোনাতলায় এক বার মিলিটারির সামনে পড়ে গেলাম না? আমি আর সতীশ ধানক্ষেতে রাইফেল লুকিয়ে একটু এগিয়েছি, অমনি মুখোমুখি। ভাগ্য ভালো-দলের আর কেউ ছিল না। আমাদের সঙ্গে। আট-দশটা জোয়ান ছেলে একসঙ্গে দেখলে কি আর রক্ষা ছিল? দু জন ছিলাম বলেই বেঁচেছি। সতীশ অবশ্যি দারুণ ভয় পেয়েছিল। নারকেলের পাতার মতো কাঁপতে শুরু করেছে। আমি নিজেও হকচকিয়ে গিয়েছি। ছ জন মিলিটারি ছিল সব মিলিয়ে, যেমন চেহারা তেমন স্বাস্থ্যু। তারা জানতে চাইল, কোন বাড়িতে কচি ডাব পাওয়া যাবে। আমরা ওদের খাতির করে আজিজ মল্লিকের বাড়ি নিয়ে গেলাম। সতীশ গাছে উঠে কাদি কাদি ডাব পেড়ে নামাল। তারা মহাখুশি। এক টাকার একটা নোট দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিল সতীশের দিকে। সতীশ সেই নোট হাতে নিয়ে বত্রিশ দাঁতে হেসে ফেলল-–যেন সাত রাজার ধন হাতে পেয়েছে।
প্ল্যান করেছিলাম, রাতের অন্ধকারে এক হাত নেব। কিন্তু ওরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকল না। দুপুরের রোদ একটু কমতেই রওনা হয়ে গেল।
বৃষ্টি বোধ করি একেবারেই থেমে গেল। চা বানান হচ্ছে শুনছি। ওদের মিলিটারি মিলিটারি বলে চেঁচিয়ে ওঠার আগেই উঠে পড়ব। কিনা ভাবছি, তখনি অনেক দূরে কোথায় হই হই শব্দ পাওয়া গেল। নিমিষের মধ্যে আমাদের নৌকার সাড়া-শব্দ বন্ধ। চায়ের পানি ফোটার বিজ বিজ আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনো আওয়াজ নেই। হাসান বলল, নৌকা আসন্তাছে। একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল শরীরে। ধ্বক করে উঠল বুক।
কিসের নৌকা, কাদের নৌকা-কে জানে? মিলিটারিরা অবশ্যি স্পীডবোট ছাত্ম নড়াচড়া করে না। তা ছাড়া রাতের বেলা তারা ঘাঁটি ছেড়ে খুব প্রয়োজন ছাড়া নড়ে না। তবে রাজাকারের উপদ্রব বেড়েছে। তাদের আসল উদ্দেশ্য লুটপাট করা। এই পথে শরণার্থীদের নৌকা মেঘালয়ের দিকে যায়। সে সব নৌকায় হামলা করলে টাকা-পয়সা গয়না-টয়না পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে অল্পবয়সী সুশ্ৰী মেয়েও পাওয়া যায়। দূরের নৌকা দেখলাম স্পষ্ট হয়েছে। সেখান থেকে ভয় পাওয়া গলায় কে যেন হাক দিল, কার নৌকা গো?
আমাদের নৌকা থেকে মজিদ চেঁচিয়ে বলল, তোমার কার নৌক?
ব্যাপারীর নৌকা। মাছ যায়।
শুনে পেটের মধ্যে হাসির বুদবুদি ওঠে। ব্যাপারী মাছের চালান দেয়ার আর সময় পেল না। আর মাছ নিয়ে যাচ্ছে এমন জায়গায়, যেখানে দেড় টাকায় একএকটা মাঝারি সাইজের রক্তই পাওয়া যায়। হুমায়ূন ভাইয়ের গম্ভীর গলা শোনা গেল, এই যে মাছের ব্যাপারী, নৌকা আন এদিকে।
কী আশ্চৰ্য, এই কথাতেই নৌকার ভেতর থেকে বহুকণ্ঠের কান্না শুরু হয়ে গেল! ছোট ছোট ছেলেমেয়ের গলার আওয়াজও আছে। এই বাচ্চাগুলি এতক্ষণ কী করে চুপ করে ছিল তাই ভাবি। নৌকার ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। মজিদ বলল, ভয় নাই ব্যাপারী, নৌকা কাছে আন।
আপনারা কী করেন?
ভয় নাই, আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক। আস এদিকে, কিছু খবর নেই।
মুক্তিবাহিনী, মুক্তিবাহিনী! আনন্দের একটা হাল্লা। উঠল। নৌকা দুটিতে। অনেক কৌতূহলী মুখ উঁকি মারল। এরা হয়তো আগে কখনো মুক্তিবাহিনী দেখে নি, শুধু নাম শুনেছে। মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় কৌতূহলী মুখগুলি দেখতে ভালো লাগে।
নমস্কার গো বাবাসকল। আমার নাম হরি পাল। কাসুন্দিয়ার জগৎ পালের নাম তো জানেন। আমি জগৎ পালের ছোট ভাই। আমার আর জ্যাঠার পরিবার আছে। এই নৌকায়। মোট একুশ জন।
হরি পাল লোকটা বাক্যবাগীশ। কথা বলেই যেতে লাগল। দেখতে পাচ্ছি, তার ঘনঘন তৃপ্তির নিঃশ্বাস পড়ছে। নৌকার ভেতরের ছেলেমেয়েগুলির কৌতূহলের সীমা নেই। ক্রমাগত উঁকিঝুকি দিচ্ছে। এদের মধ্যে একটি মেয়ের চেহারা এমন মনকাড়া যে চোখ ফেরান যায় না। আমি বললাম, ও খুকি, কী নাম তোমার?
খুকি জবাব দেবার আগেই হরি পাল বলল, এর ডাকনাম মালতী। ভালো নাম সরোজিনী। আর এর বড়ো যে, তার নাম লক্ষ্মী। ভালো নাম কমলা। ও মালতী, বাবুরে নমস্কার দে। মালতী ফিক করে হেসে ফেলল। হরি পালকে চা খেতে দেওয়া হল এক কাপ। এত তৃপ্তি করে সে বোধ হয় বহু দিন চা খায় নি। খাওয়া শেষে ভোঁস ভোঁস করে কেঁদে ফেলল। তাদের কাছে আমাদের একটিমাত্র জিজ্ঞাসা ছিল–শিয়ালজানী খালে কোনো নৌকা বাঁধা দেখেছে। কিনা। আমাদের একটি দল সেখানে থাকার কথা। কিন্তু হরি পাল বা হরি পালের মাঝি, কেউই সে-কথা বলতে পারল না।
হাসান আলি নৌকা ছেড়ে দিল। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে দাঁড় পড়ছে। হরি পালদের নৌকাকে পেছনে ফেলে এগচ্ছি, হঠাৎ শুনলাম ইনিয়েবিনিয়ে সে–নৌকা থেকে কে একটি মেয়ে কাঁদছে। হয়তো তার স্বামী নিখোঁজ হয়েছে, হয়তো তার ছেলেটিকে বেঁধে নিয়ে গেছে রাজাকাররা। নিস্তব্ধ দিগন্ত, বিস্তৃত জলরাশি, আকাশে পরিষ্কার চাঁদ-এ সবের সঙ্গে এই করুণ কান্না কিছুতেই মেলান যায় না। শুধু শুধু মন খারাপ হয়ে যায়।