মুক্তিবাহিনী চলাচল হচ্ছে এ খবর কী করে পেল কে জানে!, হুমায়ূন একটু বিরক্ত হল। মুখে কিছুই বলল না। অবশ্য ভয় পাবার তেমন কিছু নেইও। মিলিটারিরা কিছুতেই এই রাত্রিতে থানার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বাইরে বেরুবে না। মজিদ বলল, হুমায়ূন ভাই, পজিশন নেব কোথায়? সব খানাখন্দ তো পানিতে ভর্তি। সাপখোপও আছে কিনা কে জানে।
নৌকার অনেকেই এই কথায় হেসে উঠল! মজিদ রেগে গিয়ে বলল, হাস কেন? ও মিয়ারা, হাস কেন? মজিদ রেগে যাওয়াতেই হাসিটা হঠাৎ করেই থেমে গেল। নৌকা নীরব হল মুহূর্তেই। তখনি শোনা গেল, বাইরে ঝুপরূপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝি দু জন ভিজে চুপসে গেছে। জাফর বলল, মাঝিরা তো দেখি গোসল সেরে ফেলেছে।
হ গো ভাই, তিন দফা গোসল হইল।
জাফর সুর করে বলল, বাইচ বাইতে মর্দ লোকের কাম।
মজিদ ক্রমাগতই বিরক্ত হচ্ছিল। ভয় করছিল তার। ভয় কাটোনর জন্যেই জিজ্ঞেস করল, মর্টার কোথায় ফিট করেছ তোমরা? থানা কত দূর?
গোঁসাই পাড়ায়। বেশি দূর না। পরথমে সেইখানে যাইবেন?
না-না, যাওয়ার দরকার কী? তাদের কাজ তারা করবে। হুমায়ূন ভাই কী বলেন?
হুমায়ূন কিছু বলল না, চুপ করে রইল। তার মচকে-যাওয়া পা ব্যথা করছিল। সে মুখ কুচকে বসে রইল। তীর থেকে কে এক জন চেঁচিয়ে ডাকল, কার নাও? কার নাও?
নৌকার মাঝি রসিকতা করল, হেঁড়ে গলায় বলল, তোমার নাও।
নাও ভিড়াও মাঝি, খবর আছে, নাও ভিড়াও।
নৌকা ভিড়ল না, চলতেই থাকল এবং কিছুক্ষণ পরেই তীব্র টর্চের আলো এসে পড়ল নৌকায়।
নৌকা ভিড়াও মাঝি, সামনে রাজাকার আছে।
কোনখানে?
শেখ জানির খালের পারে বইসা আছে।
থাকুক বইসা, তুমি কেডা গো?
আমি শেখজানি হাইস্কুলের হেড-মাস্টার আজিজুদ্দিন। মুক্তিবাহিনীর নাও নাকি?
মনে অয় হেই রকমই।
নৌকা ভিড়ল না, কারণ নৌকা শেখজনির খালে যাচ্ছে না। আজিজদ্দিন মাস্টার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই মাঝরাত্রে সে ছয় ব্যাটারির টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন কে জানে?
এখান থেকেই গ্রামের চেহারাটা বদলাতে শুরু করেছে। দুটি আস্ত বাড়ি, তার পরপরই চারটি পুড়ে-যাওয়া বাড়ি। আবার একটা গোটা বাড়ি নজরে আসছে, আবার ধ্বংসস্তুপ। মিলিটারিরা প্ৰায় নিয়মিত আসছে। এদিকে। লোকজন পালিয়ে গেছে। ফসল বোনা হয় নি। চারিদিক জনশূন্য। নৌকা যতই এগিয়ে যায়, ধ্বংসলীলার ভয়াবহতা ততই বেড়ে ওঠে। আর এগোন ঠিক নয়। রাজাকারদের ছোটখাট দল প্রায়ই নদীর তীর ঘেঁষে ঘুরে বেড়ায়! নজর রাখে রাতদুপুরে কোনো রহস্যজনক নৌকা চলাচল করছে কিনা। তাদের মুখোমুখি পড়ে গেলে তেমন ভয়ের কিছু নেই। তবে আগেভাগেই গোলাগুলীর শব্দে চারিদিক সচকিত করে লাভ কী?
রুস্তম ভাই, এই রুস্তম ভাই।
কেন্ডা গো?
আমি চান্দু, পাঞ্জাবী মিলিটারি, হিহিহি। নৌকা থামান।
নৌকার গতি থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। একটি ছোটখাট রোগা মানুষ লাফিয়ে উঠল। নৌকায়। জাফর বলল, কী ব্যাপার, কী চাও তুমি? কে তুমি?
আমি কেউ না, চান্দু!
কী কর তুমি?
আমি খবরদারী করি। আপনেরার সাথে যামু। যা করবার কন করুম।
রুস্তম বলল, চান্দুরে লন সাথে, খুব কামের ছেলে। গ্রেনেড নিয়া একেবারে থানার ভিতরে ফালাইব দেখবেন।
চান্দু গম্ভীর হয়ে বলল, নামেন গো ভালোমানুষের পুলারা। জিনিসপত্র যা আছে, আমার মাথায় দেন। পিনপিনে বৃষ্টি মাথায় করে দলটি নেমে পড়ল। সবে মাটিতে পা দিয়েছে, অমনি দূরাগত বিকট আওয়াজ কানে এল। কী হল, কী হল। দল দাঁড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ। মজিদ উৎকণ্ঠিত স্বর বের করল, হুমায়ূন ভাই, কী ব্যাপার? উত্তর দিল চান্দু, কিছু না। পুল ফাটাইয়া দিছে। সাবাস, ব্যাটা বাপের পুত।
তা হলে ব্রীজ উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আহ কি আনন্দ! ভয় কমে যাচ্ছে সবার। সবাই দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ। বিকট শব্দটা হম হম করে প্রতিধ্বনি তুলল। থানার হলুদ রঙের দালানটি দেখা যাচ্ছে। রঙ দেখা যাচ্ছে না। কাঠামোটা স্পষ্ট নজরে আসছে। থানার আশেপাশে দু, শ গজের মতো জায়গা পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। ঘরবাড়ি নেই, গাছপালা নেই।–খাঁ-খাঁ করছে। অনেক দূর থেকে যাতে শক্রর আগমন টের পাওয়া যায়, সেই জন্যেই এই ব্যবস্থা।
তিনটি দলে ভাগ হয়ে অপেক্ষা করছে ছেলেরা। এদেরও অনেক পেছনে আধইঞ্চি মর্টার নিয়ে অপেক্ষা করছে একটি ছোট্ট দল, যে-দলে পেনসনভোগী এক জন বৃদ্ধ সুবাদার আছেন। পুরনো লোক। তার উপর বিশ্বাস করা চলে। উত্তর দিকের ঢালু অঞ্চলটায় রুস্তম একাই আট হয়ে বসেছে। মাটি হয়েছে। পিছল। এল. এম. জি.র পা পিছলে আসে। কিন্তু সে সব এখন না ভাবলেও চলে।
চান্দু বসে আছে জাফরের পাশে। তার ইচ্ছে–বুকে হেঁটে থানার সামনে যে— দুটি বাঙ্কার, সেখানে গ্রেনেড ছুঁড়ে আসে। এ কাজ নাকি সে আগেও করেছে। জাফর কান দিচ্ছে না। তার কথায়।
বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশ আবার পরিষ্কার হয়েছে। তারা দেখা যাচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে হুঁ-হু করে। ঘণ্টা দু য়েকের ভেতর অন্ধকার কেটে গিয়ে আকাশ ফর্স হবে। শুরু হবে আরেকটি সূর্যের দিন।
কৰ্দমাক্ত ভেজা জমি। চারপাশের গাঢ় অন্ধকার, ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা–এর মধ্যেই নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে সবাই। কেমন যেন অদ্ভুত লাগে। রুস্তম ফিসফিস করে বলে, পায়ের উপর দিয়ে কী গেল, সাপ নাকি? ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগল। তার কণ্ঠস্বর অন্য রকম শোনায়। কেউ কোনো জবাব দেয় না। সবাই অপেক্ষা করে সেই মুহূর্তটির জন্যে, যখন মনে হবে পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। রাইফেলের উপর ঝুঁকে থাকা একেকটি শরীর আবেগে ও উত্তেজনায় কাঁপতে থাকবে থরথর করে।