মেথিকান্দার আশেপাশে যারা থাকে, গুলীর শব্দ তারা অনেক বারই শুনেছে। অনেক বার ব্যৰ্থ আক্রমণ হয়েছে এখানে। কিন্তু কেউ মুক্তিবাহিনী দেখে নি, এটা কেমন কথা। হয়তো সবাই বিল পার হয়ে ছোট খাল ধরে এগিয়েছে। আমাদের মতো গ্রামের ভিতর দিয়ে রওনা হয় নি। যাই হোক, এ নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে। না। বমি-বমি লাগছে। মাথাটা এমন ফাঁকা লাগছে কেন। বীজটা ঠিকমতো ওড়াতে পারবে তো? এমন যদি হত, সবাই ঠিকঠাক ফিরে এসেছে, কারো গায়ে আচড়টি লাগে নি। তা কি আর হবে? কি একটা গান আছে না। সুবীর সেনের–মন নিতে হলে মনের মূল্য চাই। ও কি, মাথা ঘুরছে নকি?
আপনার কী হয়েছে, এ রকম করছেন কেন?
কিছু হয় নি। এই তো, এই তো গুলীর শব্দ পাচ্ছি। হামিদা, যুদ্ধ শুরু হল।
বাতাসে জানালা নড়ার শব্দ শুনছেন–
মর্টারের শেল ফাটার আওয়াজ পাচ্ছি না?
আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন। মাথায় পানি দিই?
মেয়েটির মাথা নিচু হয়ে এসেছে। কিন্নরী না নাম? উঁহু, হামিদা। তাহলে কিন্নরী নাম কার? বেশ সুশ্ৰী মেয়েটি। গলাটি কী লম্বা! ফর্সা, হাঁসের মতো। ঐ তো, আবার শেল ফাটার আওয়াজ। আহি পুরোদমে ফাইট চলছে।
আপনি নড়াচড়া করবেন না। চুপ করে শুয়ে থাকুন।
অনেক অপরিচিত মহিলা ঘরের ভেতরে ভিড় করছেন। মোক্তার সাহেবকে দেখছি না তো। মোক্তার সাহেব কোথায়? এই দাড়িওয়ালা লোকটি কে?
রামদিয়ার ঘাটে তারা যখন পৌঁছল, তখন আকাশ আবার মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে, বিজলি চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। দমকা বাতাসে শো শো শব্দ উঠছে বাশবনে। হুমায়ূন পিছিয়ে পড়েছিল। হোঁচটি খেয়ে তার পা মচকে গিয়েছে। সে হাঁটছে খুঁড়িয়ে-খুড়িয়ে। জাফর গলা উঁচিয়ে ডাকল, হুমায়ূন ব্রাদার, হুমায়ূন ব্রাদার।
তার ডাকার ভঙ্গিটা ফুর্তিবাজের ভঙ্গি। সব সময় এ-রকম থাকে না। মাঝেমধ্যে আসে। হুমায়ূন হাসল মনে মনে। সেও খুব তরল গলায় সাড়া দিল, কী ব্যাপার জাফর?
বৃষ্টি আতা হায়। বহুত মজাকা বাত।
বলতে-বলতেই টুপটুপ করে বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল। জাফর হেসে উঠল হো-হো করে। যেন এ সময় বৃষ্টি আসাটা খুব একটা আনন্দের ব্যাপার।
হাসান আলি মাথার বাক্স নামিয়ে তার উপর বসে ছিল–যদিও বেশ বেগে হাওয়া বইছে, তবু সে লাল গামছা দুলিয়ে নিজেকে হাওয়া করছিল। বৃষ্টি আসতে দেখে সেও কী মনে করে যেন হাসল।
মজিদ একটা সিগারেট ধরিয়েছে। ফুস-ফুস করে ধোঁয়া ছাড়ছে। সে বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এখানে দাঁড়িয়ে তার ক্লান্তি আরো বেড়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল, কী ব্যাপার হাসান আলি, টুনু মিয়ার দল কোথায়?
হাসান আলি সে কথার জবাব দিল না, গামছা দুলিয়ে হাওয়া করতেই লাগল। মজিদ গলা উঁচিয়ে বলল, কথা বলছি না যে, কী ব্যাপোর?
নৌকা আসতাছে। বিশ্রাম করেন মজিদ ভাই।
হুমায়ূন ও জাফর এসে বসল হাসান আলির পাশে। বৃষ্টি নামতে-নামতে আবার থেমে গেছে। বসে থাকতে মন্দ লাগছে না। তাদের। রামদিয়ার ঘাটে টুনুমিয়ার দলকে না দেখতে পেয়ে তারা সে-রকম অবাক হল না। জাফর হঠাৎ সুর করে বলল, ওগো ভাবীজান, মর্দ লোকের কাম।
তারা সবাই মিনিট দশেক বসে রইল। চারিদিকে ঘন অন্ধকারে মাঝে মাঝে সিগারেটের ফুলকি আগুন জ্বলছে-নিভিছে। ঝিঝি পোকার একটানা বিরক্তিকর আওয়াজ ছাড়া অন্য আওয়াজ নেই। হাসান আলি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নৌকা দেখা যায়। উঠেন, সবেই উঠেন।
দেশী ডিঙ্গি নৌক ঠেলে উজানে নিয়ে আসছে।
হাসান আলি উঁচু গলায় সাড়া দিল, হই হই হই-হা।
নৌকা থেকে এক জন চেঁচিয়ে উঠল, হাসান ভাই নাকি গো? ও হাসান ভাই।
কী।
ঠিকমতো পৌঁছছেন দেহি।
হাসান আলি আচমকা প্রগলভ হয়ে উঠল। নৌকা পাড়ে ভিড়তেই নৌকার দড়ি ধরে শিশুর মতো চেঁচিয়ে উঠল, টুনু মিয়া, ও টুলু মিয়া?
নৌকার ভেতর থেকে একসঙ্গে উঁচু স্বরগ্রামে হেসে উঠল সবাই। টুনু মিয়া লাফিয়ে নামল নৌকা থেকে, বেঁটেখাট মানুষ। পেটা শরীর, মাথার চুল ছোট-ছোট করে কাটা। সে হাসিমুখে এগিয়ে গেল হুমায়ূনের দিকে।
আমারে চিনছেন কমাণ্ডার সাব? আমি টুনু। বাজিতপুরের টুনু মিয়া। বাজিতপুর থানায় আপনার সাথে ফাইট দিছি।
হুমায়ূন বলল, তোমরা দেরি করে ফেলেছ, আড়াইটা বাজে।
আগে কন আমারে চিনছেন কিনা।
চিনেছি, চিনেছি। চিনব না কেন?
বাজিতপুর ফাইটে আমার বাম উড়াতে গুলী লাগল। আপনে আমারে পিঠে লইয়া দৌড় দিলেন। মনে নাই আপনার?
খুব মনে আছে।
বাঁচনের আশা আছিল না। আপনে বাঁচাইছেন। ঠিক কইরা কন, আমারে চিনছেন? সেই সময় আমার লম্বা চুল আছিল।
হুমায়ূন অবশ্যি সত্যি চিনতে পারে নি, তবু আজকের এই মধ্যরাতে স্বাস্থ্যবান হাসি-খুশি এই তরুণটিকে অচেনা মনে হল না। দলের অন্যান্য সবাই নেমে এসেছে। হাসান আলি তাদেরকে কী যেন বলছে, আর তারা ক্ষণে ক্ষণে হেসে উঠছে। কে বলবে এই সব ছেলেদের জীবন-মৃত্যুর সীমারেখা কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্পূৰ্ণ মুছে যাবে।
জাফর বলল, আর লোকজন কোথায়?
আছে, জায়গা মতোই আছে।
তাহলে আর দেরি কেন? নৌকা ছাড়া যাক। হুমায়ূন ভাই কী বলেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ, উঠে পড় সবাই।
নৌকায় উঠে বসতেই বড়ো বড়ো ফোটায় বৃষ্টি নামল। নৌকা যদিও ভাটির দিকে যাচ্ছে, তবু বাতাসের ঝাপটায় এগোচ্ছে ধীর গতিতে, মাঝে মাঝে তীরে গজিয়ে-ওঠা বেতঝোপে আটকে যাচ্ছে। যত বারই নৌকা আটকে যাচ্ছে, তত বারই মাঝি দুটি গাল পাড়ছে, ও হালার পুত, ও হারামীর বাচ্চা। গ্রামের ভেতর দিয়ে নৌকা যাবার সময় মেঘ ধরে গেল। তীরে বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে অনেক কৌতূহলী লোক বসে আছে। দু-এক জন সাহস করে নিচু গলায় বলছে, জয় বাংলা।