এত দিন শুধু ছোটখাটো হামলা করেছি। বিভিন্ন থানায় ছোটখাটো খণ্ডযুদ্ধের পর রাতারাতি সরে এসেছি নিরাপদ স্থানে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ব্যতিব্যস্ত করে রাখা। মুহুর্তের জনোও যেন শান্তির ঘুম না দিতে পারে। কিন্তু আজকের ব্যাপার অন্য। আজ আমরা খুটি গেড়ে বসব। আহা, আবার চোখে জল আসে। কেন?
পর্দার আড়াল থেকে সুশ্ৰী একটি মেয়ে উঁকি দিয়ে আমায় দেখে গেল। বেশ মেয়েটি। ইচ্ছে হচ্ছিল ডেকে কথা বলি। কিন্তু ইচ্ছাটা গিলে ফেলতে হল। এ বাড়িতে কিছু সময় থাকতে হবে আমাকে। এ সময় এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে এ বাড়ির লোকজন বিরক্ত হয়।
স্নামালিকুম।
অলায়কুম সালাম।
আমি গনি মিয়ার চাচাত ভাই। উত্তরের বাড়িতে থাকি। মিয়া সাহেবের শরীলডা এখন কেমুন?
ভালো।
শুধু গনি মিয়ার চাচাত ভাই-ই নয়, আরো অনেকেই জড়ো হয়েছে। সম্ভবত আরো লোকজন আসছে। আমার বিরক্ত লাগছে, আবার ভালোও লাগছে। বিরক্ত লাগছে কথা বলতে হচ্ছে বলে, ভালো লাগছে লোকজনদের কৌতূহলী চোখ দেখে। তোমরা তাহলে শেষ পর্যন্ত কৌতূহলী হয়েছ? দেখতে এসেছ মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের? বেশ বেশি।
ইস, কী দিনই না গিয়েছে। শুরুতে। গ্রামবাসী দল বেঁধে মুক্তিবাহিনী তাড়া করেছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে। অবশ্যি তাদেরই—বা দোষ দিই কী করে? মিলিটারি রয়েছে ওৎ পেতে। যেই শুনেছে অমুক গ্রামে মুক্তিবাহিনী ঘোরাফেরা করছে, হুকুম হল–দাও ঐ গ্রাম জ্বালিয়ে। যেই শুনেছে অমুক লোকের বাড়ি মুক্তিবাহিনী এক রাত্রি ছিল, অমনি হুকুম হল, অমুক লোককে গুলী করে মারি গ্রামের মধ্যিখানে, যাতে সবার শিক্ষা হয়। আহ, শুরুতে বড়ো কষ্টের দিন গিয়েছে।
কয়টা বাজে এখন? আমার কাছে ঘড়ি নেই। সময়টা জানা থাকলে হত। বুঝতে পারতাম। কখন গুলীর আওয়াজ পাব। অবশ্যি প্রথম শুনব বীজ উড়িয়ে দেবার বিকট আওয়াজ। ব্রীজটা ওড়াতে পারবে তো ঠিকমতো? শুনেছি রেঞ্জাররা পাহারা দেয়। সারা রাত। খুব অস্থির লাগছে। ওদের সঙ্গে গেলেই হত। না-হয় একটু দূরে বসে থাকতাম। রেসের ঘোড়ার মতো হল দেখি। রেসের ঘোড়া বুড়ো হয়ে গেলে শুনেছি। অর্ধ-উম্মাদ হয়ে যায়। রোস শুরু হলে পাগলের মতো পা নাচায়।
আপনার জন্যে দুধ আনব এক গ্লাস?
সেই সুশ্ৰী মেয়েটি ঘরের ভেতর ঢুকেছে দেখে অবাক লাগছে। গ্ৰামঘরের বাড়িতে এ-রকম তো হয় না। বেশ কঠিন পর্দার ব্যাপার থাকে। আমার খানিকটা অস্বস্তি লাগছে। গনি মিয়ার ভাই, যিনি আমার বিছানার পাশে বসেছিলেন, তিনিও আমার অস্বস্তি লক্ষ্য করলেন।
মেয়েটি আবার বলল, আনব আপনার জন্যে এক গ্লাস দুধ?
না-না, দুধ লাগবে না।
খান, ভালো লাগবে। আনি?
আন।
গনি মিয়ার চাচাত ভাই বললেন, বড়ো ভালো মেয়ে। শহরে পড়ে।
কী পড়ে?
বি… এ… পড়ে। হোস্টেলে থাকে।
শুনে আমি অপ্রস্তুত। তুমি তুমি করে বলছি, কী কাণ্ড! কামিজ পরে আছে বলেই বোধহয় এত বাচ্চা দেখা যায়। তাছাড়া তার হাবভাবও ছেলেমানুষী।
মেয়েটি মোক্তার সাহেবের বড়ো ভাইয়ের মেয়ে। বড়ো ভাই ও ভাবী দু জনেই মেয়েটিকে ছোট রেখে মারা গেছেন। মেয়েটি মোক্তার সাহেবের কাছেই বড়ো হয়েছে। পড়াশোনার খুব ঝোঁক, ঢাকায় হোস্টেলে থেকে পড়ে। গণ্ডগোলের আভাস পেয়ে আগেভাগেই চলে এসেছিল।
মেয়েটি দুধের গ্লাস আমার সামনের টেবিলে নামিয়ে রাখল না, হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, তোমার নাম?
হামিদ। হামিদা বানু।
আমি চুপ করে রইলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না! অথচ মেয়েটি দাঁড়িয়েই আছে। হয়তো কিছু কথা শুনতে চায়। যুদ্ধের গল্প শুনতে মেয়েদের খুব আগ্রহ। হামিদা একসময় বলল, আমার নামটা খুব বাজে! একেবারে চাষা-চাষা নাম।
আমি বললাম, নাম দিয়ে কী হয়?
হয় না। আবার, আমার বন্ধুদের কী সুন্দর সুন্দর নাম! এক জনের নাম কিন্নরী, এক জনের নাম স্বাতী।
মোক্তার সাহেব বললেন, আপনার জন্যে ডাক্তার আনতে লোক গেছে। ভালো ডাক্তার–এল. এম. এফ.। হামিদা আম্মাজি, ভেতরে যান।
বাহ্! কী সুন্দর আম্মাজি ডাকছে। মেয়েটি বোধহয় সবার খুব আদরের। মোক্তার সাহেবের কথায় সে ঘাড় ঘুরিয়ে হাসল। আমাকে দেখতে-আসা লোকগুলি চলে যাচ্ছে একে একে। এত তাড়াতাড়ি কৌতূহল মিটে গেল? মোক্তার সাহেব অবশ্যি লোকজনদের ঝামেলা না করবার জন্যে বলছেন। তবুও তাদের আগ্রহ এত কম হবে কোন?
অন্দরমহলের ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে। পর্দার ওপাশে জটলা-পাকান মেয়েদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। হামিদা বলল, ওরা আপনাকে দেখতে চায়। মুক্তিবাহিনী কোনো দিন তো দেখে নাই।
তুমি দেখেছি নাকি?
এই তো আপনাকে দেখলাম।
বাহ, বেশ মেয়ে তো! বেশ গুছিয়ে কথা বলে। ইউনিভার্সিটিতে আমাদের সঙ্গে পড়ত।–শেলী রহমান। সেও এরকম গুছিয়ে কথা বলত–একেক বার আমাদের হাসিয়ে মারত। শেলী রহমানের বাবা তো পুলিশ অফিসার ছিলেন, মিলিটারির হাতে মারা যান নি তো।
কয় ভাইবোন আপনারা?
আমি একা। ভাইবোন নেই কোনো।
ভাইবোন না থাকা খুব বাজে।
এ কী! গুলীর আওয়াজ শুনলাম না? তাহলে কি শুরু হল নাকি? তিনটে বেজে গেছে। এর মধ্যে। আমি ছটফট করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম, কয়টা বাজে হামিদা, একটু জেনে আসবে? মোক্তার সাহেব বললেন, দুটো পাঁচশ। কী আশ্চর্য, এখনো তো যুদ্ধ শুরুর সময় হয় নি।
হামিদা বলল, কী হয়েছে?
গুলীর আওয়াজ শুনলাম।
কই না, না তো!
আমি তো শুনলাম নিজ কানে।
মোক্তার সাহেব বললেন, না, গুলীর আওয়াজ নয়। গুলীর আওয়াজ হলে বুঝতাম। কত বার যুদ্ধ হল এখানে।