হুমায়ূন ভাই বোধহয় কোনো একটা রসিকতা করলেন। ভ্যাক ভ্যাক করে হাসছে সবাই। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম বলে শুনতে পাই নি। এখন সবাই হাসছে, আমি মুখ কালো করে বসে আছি। নিশ্চয়ই বোকা— বোকা লাগছে আমাকে। কে জানে, রসিকতাটা হয়তো আমাকে নিয়েই। সবাই যে-ভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে, তাতে তাই মনে হয়। ও কি, হাসান আলিও হাসছে দেখি।
হাসো বাবা, হাসো। যত ইচ্ছে হাস। কিছুক্ষণ পরই যখন বমবাম করে মটারের শেল ভাঙা শুরু হবে, তখন এত রস আর থাকবে না। কাজেই এই-ই হচ্ছে গোল্ডেন আওয়ার।
পান আনব। পান খাবেন?
জিজ্ঞেস করল কে যেন। আমি মাথা নাড়লাম। পানটান লাগবে না রে বাবা। বিনা পানেই চলবে। মুড নেই। পান, সিগারেট, চা–এসব হচ্ছে মুডের ব্যাপার; মুড না থাকলে বিষের মতো লাগে।
হুমায়ূন ভাই বললেন, আমরা রওনা হচ্ছি। আনিস, তুমি থাক। ফেরবার পথে তোমাকে নিয়ে যাব। তিনি তাহলে ফেরবার চিন্তাও করছেন! ভুলে গেছেন নাকি, মেথিকান্দা মুক্তিবাহিনীর মৃত্যুকূপ। আজ যাত্রা থেকেই অলক্ষণ শুরু হয়েছে। নৌকাও ছাড়ল, বৃষ্টিও নামল। হুমায়ূন ভাই একটা প্রচণ্ড উপকাঁপাত দেখলেন। আনিস হয়ে পড়ল অসুস্থ। শেষটায় কী হবে কে জানে?
বড়ো অস্থির লাগছে। ইয়া মুকাদেমু, ইয়া মুকাদেমু, ইয়া মুকাদেমু-কে যেন বলেছিল যুদ্ধের সময় এই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো দোওয়া–যার অর্থ হে অগুসরকারী। এই তোয়া পড়ে শুধু এগিয়ে যাওয়া!
না, বড়ো খারাপ লাগছে। ভালোয় ভালোয় ফিরে এলে আর যাব না। সম্ভব হলে ফিরে যাব মৈমনসিংহ। কিন্তু গিয়ে করবটা কী? মা কোথায় আছেন কে জানে? বাবা বেচারা মরে বেচেছেন। কোনো দায়দায়িত্ব নেই। কিন্তু আমিই—বা কোন দায়িত্ববান সুপুত্রটি? বাবাকে ধরে নিয়ে গেল মিলিটারি, আমিও এলাম পালিয়ে, অথচ নিশ্চিত জানি মায়ের কোনো সহায়-সম্বল নেই। বোনগুলি বোকার বেহদ। ফিরে গিয়ে হয়তো দেখব অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ণ ফ্রন্ট। কেউ নেই, সব সাফ হয়ে গেছে। মন্দ হয় না খুব। বাঁধা-বন্ধনহীন বল্লাহারা জীবন। কী আনন্দ!
অবশ্যি এমনও হতে পারে দেশ স্বাধীন হবে। আমি মৈমনসিংহ ফিরে যাব। বাবাকে হয়তো তারা প্ৰাণে মাঠে নি। তিনি জেল থেকে বেরিয়ে আসবেন! আবার আমরা সীতাকুণ্ড যাব। পাহাড়প্রমাণ জিনিসপত্র তোলা হবে ট্রেনে। একসময় ট্রেন ছেড়ে দেবে, দেখব বাবা প্ৰাণপণে দৌড়াচ্ছেন। আহ, চোখে জল আসে কেন?
মোক্তার সাহেব, দোওয়া রাখবেন। খোদা হাফেজ, আনিস।
খোদা হাফেজ। খোদা হাফেজ।
আনিস সাবেত
আনিস সাবেত
আমার মন বলছে আজকের যুদ্ধে হুমায়ূন ভাই মারা যাবেন। নৌকার ছাদে বসে তিনি যখন আপন মনে গুনগুন করছিলেন, তখনি আমার এ কথাটা মনে হয়েছে। কিছুক্ষণ পর তিনি নেমে এসে বললেন, অনেকগুলি উপকাঁপাত হল। একটা তো প্রকাণ্ড। তখনি আমি নিশ্চিত হয়েছি। আমার মনের মধ্যে যে-কথাটি ওঠে, তাই সত্যি হয়। এ আমি অনেক বার দেখেছি।
সেবার স্বরূপহাটির রেলওয়ে কালভার্ট ওড়াতে গিয়েছি।–আমি, রহমান আর ওয়াহেদ। রহমানের আবার খুব চায়ের নেশা। খুঁজে-খুঁজে চায়ের দোকানও একটা বের করেছে। বিস্বাদ তেতো চা–তাতে চুমুক দিয়ে রহমান চেচিয়ে উঠল, ফার্স্ট ক্লাস চা। আর তখনি কেন জানি আমার মনে হল, রহমানের কিছু-একটা হবে। হলও তাই। হুমায়ুন ভাইয়ের বেলাও কি তাই হবে?
হুমায়ূন ভাইয়ের ঢাকার বাসার ঠিকানা আছে আমার কাছে) ১০/৭ বাবর রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-৭। দোতলায় থাকেন তাঁর খাবা-মা। যদি সত্যি কিছু হয়, তাহলে এই ঠিকানায় খবর দিতে আমি নিজেই যাব। তাঁর মা নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন তাঁর ছেলে কী ভাবে থাকত, কী করত। সব বলব আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তাঁরা হয়তো ছেলে কোথায় মারা গেছে, দেখতে চাইবেন। আমি নিজেই তাঁদের নিয়ে আসব। আমরা আজ যে-পথে এসেছি, সেই পথেই আনিব। বলব, রাতটা ছিল অন্ধকার। নক্ষত্রের আলোয় আলোয় এসেছি। পথে মোক্তার সাহেবের বাড়িতে ভাত খেয়েছি। হুমায়ূন ভাইয়ের মা হয়তো মোক্তার সাহেবকে দেখতে চাহবেন। মোক্তার সাহেবকে হয়তো তিনি বলবেন, আপনি আমার ছেলেকে শেষ বারের মতো ভাত খাইয়েছেন। আল্লাহ। আপনার মঙ্গল করুক।
ক্যান কান্দেন?
আমাকে যে-ছেলেটি বাতাস করছিল, সে অবাক হয়ে আমার কাঁদবার কারণ জানতে চাইছে। ইচ্ছে করে কি আর কাঁদছি? হঠাৎ চোখে জল এল।
মাথার মধ্যে পানি দিবেন। একটু?
না।
মাথাটা টিপা দিমু?
না-না।
সে দেখি আমার সেবা না-করে ছাড়বে না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কিন্তু আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি তো দিব্যি আরাম করে শুয়ে আছি। আর ওরা নিশ্চয়ই কাদা ভেঙে দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। রামদিয়া থেকে আরো দু মাইল উত্তরে মেথিকান্দা। সেখানে তারা হাঁটা-পথে যাবে, না কায় ?
টুনু মিয়ার দলে মোট কত জন ছেলে আছে ? হুমায়ুন ভাই এক বার বলেছিলেন, কিন্তু এখন দেখি ভুলে বসে আছি। ওদের সাথে দু ইঞ্চি মর্টারও আছে। মেথিকান্দা আজ নিশ্চয়ই দখল হবে। সুজনতালির রেলওয়ে পুলও উড়িয়ে দেওয়া হবে। সমস্ত অঞ্চলটা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে স্বাধীন বাংলার ফ্ল্যাগ উড়িয়ে দেব। ফাইন। কে জানে, এত গোলমালে কেউ কি আর জাতীয় পতাকার কথাটা মনে রাখবে? স্থানীয় লোকজনের কাছে নিশ্চয়ই স্বাধীন বাংলার ফ্ল্যাগ পাওয়া যাবে। আগে তো ঘরে ঘরে ছিল। মিলিটারি আসবার পর সবাই হয় পুড়িয়ে ফেলেছে, নয়তো এমন জায়গায় লুকিয়েছে যে ইদুরে খেয়ে গিয়েছে। এমন দিনে একটা ঝকঝকে নতুন ফ্ল্যাগ চাই।