দেখতে পাচ্ছি, আনিসকে নিয়ে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। হাসান আলি পানি ঢালছে মাথায়। জাফর প্রবল বেগে হাতের তালুতে গরম তেল মালিশ করছে। বাড়ির কর্তা, মোক্তার সাহেব বিপন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এতক্ষণ লক্ষ করি নি পেছন থেকে দেখলে মোক্তার সাহেবকে অনেকটা আমার বাবার মতো দেখায়। ঠিক সে-রকম ভয়াট শরীর, প্রশস্ত কাঁধ! আশ্চর্য মিল!
আনিসের জ্ঞান ফিরল অল্পক্ষণেই এবং সে লজ্জিত হয়ে পড়ল। হুমায়ূন ভাই বললেন, নাও, দুধটা খাও আনিস।
দুধ লাগবে না, দুধ লাগবে না।
আহা খাও।
আনিস বিব্রত মুখে দুধের গ্লাসে চুমুক দিল। আনিসকে কিন্তুতকিমাকার দেখাচ্ছে। তার ভেজা মাথা থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সারা শরীরে। মুখময় দাঁড়ি— গোঁফের জঙ্গল। তার মধ্যে সরু একটা নাক ঢাকা পড়ে আছে।
জাফর বলল, আনিস থাক এখানে।
হুমায়ূন ভাই বললেন, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।
রাত দুটো বাজতে বেশি দেরি নেই। রামদিয়ায় আমাদের জন্যে টুনু মিয়ার দল অপেক্ষা করছে। হুমায়ূন ভাই বললেন, আনিস, কয়টা বাজে দেখ তো।
একটা পঁয়ত্রিশ।
বল কী!
মোক্তার সাহেব, রামদিয়া কত দূর এখান থেকে?
দূর না। দশ মিনিটের পথ।
হাসান আলি বলল, দুইটার আগে পৌঁছাইয়া দিমু। ভূলেই গিয়েছিলাম যে হাসান আলির মতো এক জন করিৎকর্মী লোক আছে আমাদের সঙ্গে। সে নাকি যা বলে, তাই করে। প্রমাণ তো দেখতেই পাচ্ছি।
বাড়ির ভেতরে রান্নাবান্না শুরু হয়েছে, বুঝতে পারছি। চিকণ গলায় কে এক জন মেয়ে ঘনঘন ডাকছে–ও হালিমা, ও হালিমা। সেইসঙ্গে দমকা হাসির আওয়াজ। একটা উৎসব উৎসব ভাব। বেশ লাগছে।
সেরেছে! আনিস দেখি বমি করছে! ব্যাপার কি? চোখ হয়েছে টকটকে লাল। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। মরেটরে যাবে না তো আবার? দুক্তোরি, কি শুধু আজেবাজে কথা ভাবছি। বুঝতে পারছি, অতিরিক্ত পরিশ্রম আর মানসিক দুশ্চিন্তায় এ রকম হয়েছে। আজ রাতটা রেস্ট নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। একটি ছেলে পাখা করছে আনিসের মাথায়। খুব বাহারে পাখা দেখি! চারিদিকে রঙিন কাপড়ের ঝালর।
জাফরও শুয়েছে লম্বা হয়ে। জাফরের শোওয়া মানেই ঘুম। ঘুম তার সাধা, কোনোমতে বিছানায় মাথাটি রাখতে পারলেই হল। ভাত রান্না হতে-হাতে সে তার সেকেণ্ড রাউণ্ড ঘুম সেরে ফেলবে। ফার্স্ট রাউণ্ড তো নৌকাতেই সেরেছে। জাফরের ঘুম আবার সুরেলা। ফুরুৎফুরুৎ করে নাক ডাকবে। এই কথা বলেছিলাম বলে এক দিন কী রাগ। মারতে আসে আমাকে। বেশ লোক দেখি তুমি। ফুরুৎ ফুরুৎ করে নাক ডাকতে পারবে, আর আমরা বলতেও পারব না? করলে দোষ নয়, বললে দোষ?
ঠিক আমার বাবার মতো। রাত-দিন কারণ্যে-অকারণে চেঁচাচ্ছেন, আর সেও কি চেঁচানি! রাস্তার মোড় থেকে শুনে লোকে খবর নিতে আসে বাসায় কী হয়েছে। মা এক দিন বিরক্ত হয়ে বললেন, কী রাত –দিন চেঁচাও! অমনি বাবার রাগ ধরে গেল। ঘাড়টাড় ফুলিয়ে বিকট চিৎকার, কী, আমি চেঁচাই?
মা সহজ সুরে বললেন, এখন কী করছ, চেঁচাচ্ছ না?
চুপ রাও। একদম চুপ।
বাবার কথা মনে হলেই এই হাসির কথাটা মনে পড়ে। এমন সব ছেলেমানুষী ছিল তাঁর মধ্যে। এক বার খেয়াল হল, আমাদের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন সীতাকুণ্ড তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি। দুমাস ধরে চলল আয়োজন। বাবার ব্যস্ততার সীমা নেই। যাবার দিন এক ঘণ্টা আগে স্টেশনে নিয়ে গেলেন সবাইকে, আর সে কি চেচনি, এটা ফেলে এসেছি ওটা ফেলে এসেছি। টেন এল, সবাই উঠলাম। পাহাড়প্রমাণ মাল তোলা হল। একসময় টেন ছেড়ে দিল, দেখা গেল বাবা উঠতে পারেন নি। প্ৰাণপণে দৌড়াচ্ছেন। হাতের কাছে যে-কোনো একটা কামরায় উঠে পড়লেই হয়, না–তা উঠবেন না। আমরা যে কামরায় উঠেছি, ঠিক সে-কামরায় ওঠা চাই। এক সময় দেখলাম, বাবা হোঁচট খেয়ে পড়েছেন। হুস-হুস করে তাঁর চোখের সামনে দিয়ে টেন চলে যাচ্ছে। আচ্ছা, মৃত মানুষরা কি মানুষের মনের কথা টের পায়? যদি পায়, তা হলে বাবা নিশ্চয়ই আমি কী ভাবছি বুঝতে পারছেন? আচ্ছা ধরা যাক, একটি লোককে সবাই মিলে ফাঁসি দিচ্ছে–তাহলে সেই হতভাগ্য লোকটির চোখে-মুখে কী ফুটে উঠবে? হতাশা, ঘৃণা, ভয়… আমা: মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল নাকি? নয়তো এ রকম অর্থহীন চিন্তা কেউ করে? ও কি, আনিস আবার বমি করছে নাকি? জোর করে দুধটা না খাওয়ালেই হত!
মোক্তার সাহেব এসে চুপি চুপি কী বলছেন হুমায়ূন ভাইকে। কে জানে, এর মধ্যেই কী এমন গোপনীয় কথা তৈরী হয়েছে যা কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতে হবে! আরে আরে, এই ব্যাপার! এটা আবার কানাকানি বলতে হবে নাকি? বলে হয়, ভাত দেয়া হয়েছে, খেতে আসেন। যত বেকুবের দল।
হাসান আলি বলল, তাড়াতাড়ি করেন, সময় নাই! মাতব্বর কোথাকার সময় নেই–সেটা তোর কাছে জানতে হবে নাকি?
খেতে বসে দেখি খিদে মরে গেছে। তরকারিতে লবণ হয়েছে বেশি হয়েছে, কাদার মতো নরম। চিবাতে হয় না, কৌৎ কোৎ করে গিলে ফেলা যায়, ভালো হল না মোটেই! জাফর বলল, হুঁ নোজ, দিস মে বি আওয়ার লাস্ট মিল। কথায় কথায় ইংরেজি বলা জাফরের স্বভাব। তার ধরন ধারণাও ইংরেজের মলে এই মহা দুর্যোগেও ভোরবেলা উঠেই তার শেভ করা চাই। দুপুরে সাবান মে মেখে গোসল সারা চাই। দিনের মধ্যে দশ বার চিরুনির ব্যবহার হচ্ছে। রূপ যাদের আছে, তারাই রূপ-সচেতন হয়। এবং এত উলঙ্গভাবে হয়, যে বড়ো চোখে লাগে।
আমাদের পাশের বাড়ির রেহানা দশ–এগারো বছর বয়স পর্যন্ত কী চমৎকার মেয়েই না ছিল, কিন্তু যেই তার বয়স তেরো পেরিয়ে গেল, যেই সে বুঝল তার চোখ ধাঁধান রূপ আছে, অমনি সে বদলে গেল। আহাদী ধরনের টেনে টেনে কথা বলা–ম-জি—দ ভা-ই, ঘন ঘন ভ্রূ কোঁচকান। জঘন্য, জঘন্য!