পায়ের কাটাটা জানান দিচ্ছে। ভাঙা শামুকের এমন ধারা প্রথমে ভাবলাম সাপে কামড়াল বুঝি। বর্ষা-বাদলা হচ্ছে সাপের সীজন। এ অঞ্চলে আবার শামুকভাঙা-কেউটের ছড়াছড়ি। ছোবল মেরে শামুক ভেঙে খায়। রাত-বিরাতে এরকম একটা সাপের গায়ে পা দিতে পারলে মন্দ হয় না। বন্দুক নিয়ে তাহলে এ রকম আর ঘুরে বেড়াতে হয় না। নিরবচ্ছিন্ন শান্তি যাকে বলে।
আমার আর ভালো লাগে না, সত্যি। কী হবে দু-একটা টুশ-টাশ করে? মিলিটারি কমছে কই? বন্যার জলের মতো শুধু বাড়ছে। রাজাকার পয়দা হচ্ছে হুঁ— হুঁ করে। যে অবস্থা, এক-দিন দেখব। আমরা কয় জন ছাড়া সবাই রাজাকার হয়ে বসে আছে। আর হবে নাই-বা কেন? প্ৰাণের ভয় নেই? রাজাকার হলে তাও প্ৰাণটা বাঁচে। তাছাড়া মাসের শেষে বাধা বেতন। লুটপাটের ঢালাও বন্দোবস্ত। দেখেশুনে মনে হয়, দূর শালা রাজাকার হয়ে যাই।
কী আরোল তাবোল ভাবছি। সোহরাব সাহেবের মতো মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল নাকি? সোহবার সাহেবকে দেখে কে বলবে, তার মাথাটা পুরো ফরটি-নাইন হয়ে বসে আছে। দিব্যি ভালো মানুষ, মাঝে মাঝে শুধু বলবে, ইস, গুলীটা শেষে কপালেই লাগল।
দু মাস ছিল বেচারা মুক্তিবাহিনীতে। সাহসী বেপরোয়া ছেলে। আমগাছ থেকে একবার মিলিটারি জীপে গ্রেনেড মেরে এক জন আর্টিলারি ক্যাপ্টেনই সাবাড়ি করে দিল। দারুণ ছেলে। এক দিন খবর পাওয়া গেল, কোন বাজারে গিয়ে নাকি ধূমসে দিশী মদ গিলে ভাম হয়ে পড়ে আছে। মদের ঝোঁকে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে আর বলছে, হায় হায়, ঠিক কপালে গুলী লেগেছে! আবু ভাইয়ের হুঁকুমে জাফর গিয়ে খুব বানোল। দুই রদ খেয়ে নেশা ছুটে গেল, কিন্তু ঐ কথাগুলি আর গেল না। রাতদিন বলত, ইস কী কাণ্ড, শেষ পর্যন্ত ঠিক কপালে গুলী! ঘুম নেই খাওয়া নেই, শুধু এই বুলি। এখন কোথায় আছে কে জানে? চিকিৎসা হচ্ছে কি ঠিকমতো? আমার যদি এ-রকম হয় তবে তো বিপদের কথা।
দাঁড়ান, সবাই দাঁড়ান।
কে কথা বলে? হাসান আলি নাকি? ব্যাটা আবার হুকুম দিতে শুরু করল কবে থেকে? জায়গাটা ঘুপচি অন্ধকার, চারদিকে বুনো ঝোপঝাড়। পচা গোবরের দম আটকান গন্ধ আসছে। হুমায়ূন ভাই বললেন, কী হয়েছে হাসান আলি?
কিছু হয় নাই।
কী হয়েছে তা নিজ চোখেই দেখতে পেলাম। আনিস লম্বালম্বি পড়ে রয়েছে মাটিতে। এত বড়ো একটা জোয়ান চোখের সামনে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল, আমি দেখতেও পেলাম না? কী আশ্চর্য! কী ভাবছিলাম। আমি? হাসান আলি ধরাধরি করে তুলল আনিসকে। কাদায়পানিতে সারা শরীর মাখামাখি। হুমায়ূন ভাই অবাক হয়ে বললেন, কী হয়েছে আনিস?
কি জানি, মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল।
দেখি তোমার হাত। আরে, এ যে ভীষণ জ্বর। কখন জ্বর উঠল?
কি জানি কখন।
আসি, আশেপাশের কোনো বাড়িতে তোমাকে রেখে যাই।
আমি হাঁটতে পারব।
পারতে হবে না। মজিদ, তুমি ওর হাতটা ধর।
গায়ে হাত দিয়ে দেখি, সত্যি গা পুড়ে যাচ্ছে। বাটা বলদ, বলবি তো শরীর খারাপ।
হাসান আলি বলল, সামনেই মুক্তার সাহেবের বাড়ি। আসেন, সেই বাড়িতেই উঠি।
জাফর বলল, কত দূর হে সেটা?
কাছেই, এক-পোয়া মাইল। জুম্মাঘরের দক্ষিণে।
হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে যায়; জুম্মাঘরও আসে না, এক-পোয়া মাইলেরও ফুরাবার নাম নেই। যতই জিজ্ঞেস করি, কত দূর হাসান আলি? হাসান আলি বলে, ঐ যে দেখা যায়।
মোক্তার সাহেবের বাড়িটি প্রকাণ্ড। গরিব গ্রামের মধ্যে বাড়ির বিশালত্ব চট মরে চোখে পড়ে। বাড়ির সামনে প্রশস্ত পুকুর। তার চারপাশে সারি–বাধা তালগাছ। আমরা বাড়ির উঠোনে দাঁড়াতেই রাজ্যের কুকুর ঘেউ ঘেউ শুরু করল। কী ঝামেলা রে বাবা! বাড়ির ভেতর থেকে কেউ এক জন পরিত্ৰাহি চেঁচাতে লাগল, আসগর মিয়া, আসগর মিয়া, ও আসগর মিয়া।
জাফর তার স্বাভাবসুলভ। উঁচু গলায় ডাকল, বাড়িতে কে আছেন? দরজা খোলেন।
হঠাৎ করে বাড়ির সব শব্দ থেমে গেল। আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। জাফর আবার বলল, ভয় নাই, আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক। তাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। শেষ পর্যন্ত হাসান আলি বলল, গনি চাচা, আমি হাসান। তখনি খুট করে দরজা খুলে গেল। একটি ভয়-পাওয়া মুখ বেরিয়ে এল হারিকেন হাতে।
হাসান আলির কারবার দেখে গা জ্বলে যায়। তার গলা শুনলে যখন দরজা খুলে দেয়, তখন গলাটা একটু আগে শোনালেই হয়। জাফর বলল, বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না। এই ছেলেটার শোওয়ার বন্দোবস্ত করেন। আমাদের ভাত খাওয়াতে পারবেন?
জ্বি জি, নিশ্চয়ই পারব।
আপনার নাম কি?
গনি। আব্দুল গনি।
ডাক্তার আছে এদিকে?
আছে, হোমিওপ্যাথ।
দুত্তোরি হোমিওপ্যাথ।
গনি সাহেব ছাড়া আরো দু জন লোক জড়ো হয়েছে। তারা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। আনিস তোষকহীন একটি চৌকিতে শুয়ে পড়েছে। গনি সাহেব বললেন, কী হয়েছে ওনার? গুলী লেগেছে নাকি?
না। আপনি ভেতরে গিয়ে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
জ্বি জ্বি।
বুড়ো ভদ্রলোক ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলে গেলেন। দেখতে–দেখতে বাড়ি জেগে উঠল। কত রকম ধ্বনি শোনা যাচ্ছে–আমিনা আমিনা হারিকোনটা কই?, দূর ধূমসী, ঘুমায় কি!
ভাগ্য ভালো, বাড়িটি এক পাশে। পাড়ার লোক সেই কারণেই ভেঙে পড়ল না। গনি সাহেব একধামা মুড়ি আর গুড দিয়ে গেলেন। বললেন, অল্পক্ষণের মধ্যেই রান্না হবে। আনিসকে তুলতে গিয়ে দেখি সে অচৈতন্য। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে।
আনিসের শরীর যে এতটা খারাপ, ধারণা করিনি। নৌকায় ওঠার সময় অবশ্যি এক বার বলেছিল বমি বমি লাগছে। কিন্তু এ রকম অসুস্থ হয়ে পড়বে, কে ভেবেছিল? আনিসটা মেয়েমানুষের মতো চাপা।