- বইয়ের নামঃ শ্যামল ছায়া
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
আবু জাফর শামসুদ্দিন
শ্যামল ছায়া
ভূমিকা
আমার বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। উনিস শ একাত্তর সনের পাঁচই মে তাঁকে দেশপ্রেমের অপরাধে পাক আর্মি গুলী করে হত্যা করে। সে সময় আমি আমার ছোট ছোট ভাইবোনদের নিয়ে বরিশালের এক গ্রামে লুকিয়ে আছি। কী দুঃসহ দিনই না গিয়েছে! বুকের ভেতর কিলবিল করছে ঘৃণা, লকলক করছে প্রতিশোধের আগুন। স্বাধীনতাটাধীনতা কিছু নয়, শুধু ভেবেছি, যদি একবার রাইফেলের কালো নলের সামনে ওদের দাঁড় করাতে পারতাম। ঠিক একই রকম ঘৃণা, প্রতিশোধ গ্রহণের একই রকম তীব্র আকাঙক্ষণ সেই অন্ধকার দিনের অসংখ্য ছেলেকে দুঃসাহসী করে তুলেছিল। তাদের যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, কোনো সহায় সম্বল ছিল না, কিন্তু শ্যামল ছায়ার জন্যে গাঢ় ভালোবাসা ছিল। আমার শ্যামল ছায়া সেই সব বন্ধুদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।
— হুমায়ূন আহমেদ
০১. আবু জাফর শামসুদ্দিন
নৌকা ছাড়তেই রূপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল।
এ অঞ্চলে বৃষ্টি-বাদলার কিছু ঠিক নেই। কখন যে হুঁড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামবে, আবার কখন যে সব মেঘ কেটে গিয়ে আকাশ ঝকঝকে হয়ে উঠবে, কেউ বলতে পারে না।
আমি নৌকার ভেতরে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লাম। বেশ শীত করছে। ঠাণ্ডা বাতাসে গায়ে কাপন লাগে। নৌকা চলছে মন্থর গতিতে। হাসান আলি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড় টানছে। এত বড়ো নৌকা কী জন্যে নিয়েছে কে বলবে। পানসির মতো আকৃতি। দাঁড় টেনে একে নিয়ে যাওয়া কি সোজা কথা?
এখন বাজছে নটা। রাত দুটোর আগে রামদিয়া পৌঁছান এ নৌকার কর্ম নয়। গুণ টেনে নিয়ে গেলে হয়তো হবে। কিন্তু গুণটা টানবে কে? আমি নেই এর মধ্যে, ভিজে গুণের দড়ি নিয়ে দৌড়ান। আমাকে দিয়ে হবে না। সাফ কথা।
বৃষ্টি দেখছি ক্রমেই বাড়ছে। বিলের মধ্যিখানে বৃষ্টির শব্দটা এমন অদ্ভুত লাগে। কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে আবার বাতাসে হিত হিত আওয়াজ উঠছে। প্যাচা ডাকার মতো। ভয় ধরে যায় শব্দ শুনে। ছেলেবেলায় এক বার এরকম শব্দ শুনে এমন ভয় পেয়েছিলাম। মানসাপোতার বিলে মাঝি দিক ভুল করেছে। চারদিকে সীমাহীন জল। বড়োরা সবাই ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করছে। তাদের হৈচৈ-এ ঘুম ভেঙে শুনেছি সেই বিচিত্র হঅ হঅ আওয়াজ। আজও সেই শব্দে ভয় ধরল। কে জানে কেন। আমি কি কোনো অমঙ্গলের আশঙ্কা করছ?
কুটকুট করে মশার কামড় খাচ্ছি। এই বিলের মধ্যে আবার মশা কোথেকে আসে? হাত-পা আর মুখে অল্প কিছু কেরোসিন তেল মেখে নিলে হত। সবাই দেখি তাই করে। হুমায়ূন ভাইও করেন। মশার উৎপাত থেকে বাঁচা যায় তাহলে। কেরোসিন মাখতে ইচ্ছে হয় না। আমার। কি জানি বাবা চামড়ার কোনো ক্ষতিই করে। কিনা। হয়তো গাল-টাল কলসে কয়লা হয়ে পড়বে। এর চেয়ে মশার কামড় অনেক ভালো। হাণ্ডেড টাইমস বেটার।
হুমায়ূন ভাইও দেখি আমার পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছেন। তাঁর ধারণা, আমি ঘুমিয়ে রয়েছি। মাথার নিচে থেকে নিঃশব্দে বালিশটা নিয়ে নিলেন। বেশ লোক যা হোক! মজিদ বা আনিস হলে আমি গদাম করে একটা ঘুষি মারতাম। পরিষ্কার একটা হাতের কাজ দেখতে পেত। চালাকি পেয়েছ, না? বালিশ ছাড়া আমি শুয়ে থাকতে পারি না। অনেকেরই দেখি মাথার নিচে কিছু নেই, কিন্তু কেমন ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকায়। আমি পারি না।
বৃষ্টির তো বড়ো বাড়াবাড়ি দেখছি। ঝড়টড় এলে বিপদ। সাঁতার যা জানি, তাতে তিন মিনিটের বেশি ভেসে থাকা যাবে না। নৌকা ড়ুবলে মার্বেলের গুলির মতো তলিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। অবশ্যি সেটাও খুব একটা মন্দ ব্যাপার হবে না। ওমা, হাসি আসছে কি জন্যে বা! সবাইকে চমকে দিয়ে হেসে উঠব নাকি?
হুমায়ূন ভাই দেখি উঠে বসেছেন। মশা কামড়াচ্ছে বোধ হয়। কিংবা কোনো কারণে ভয় লাগছে। ভয় পেলেই এ রকম অস্থিরতা আসে। মজিদ বলল, কি হুমায়ূন ভাই, ঘুম হল না?
এই ঝড়-বৃষ্টিতে ঘুম আসে নাকি? তাছাড়া টেনশনের সময় আমার ঘুম হয় না।
এক দফা চা খেলে কেমন হয়? বানাব নাকি?
বাতাসের মধ্যে চুলা ধরাবে কী করে?
হাসান মিয়া ধরাতে পারবে। ও হাসা, লাগি মেরে নৌকা দাঁড় করাও গো। চা না খেলে জুত হচ্ছে না। এহা-হে, তুমি তো ভিজে একেবারে আলুর দাম হয়ে গেছ হাসান আলি।
ভিজে আলুর দাম হয়ে যাওয়াটা আবার কী রকম! এরকম উল্টোপাল্টা কথা শুধু মজিদই বলতে পারে। এক দিন আমাকে এসে বলছে, জাফর, যা পরিশ্রম করেছি–একেবারে টমেটো হয়ে গেছি। পরিশ্রমের সঙ্গে টমেটোর কী সম্পর্ক কে জানে।
নৌকার খুঁটি গেড়ে বসে আছে। এতক্ষণে তাও নৌকার দুলুনিতে বেশ একটা ঝিমুনির মতো এসেছিল, সেটুকুও গেছে। ঘনঘন চা খেয়ে কী আরাম যে পায় লোকে, কে জানে। আনিস দেখি। আবার সিগারেটও ধরিয়েছে। নতুন খাওয়া শিখেছে। তো, তাই যখন-তখন সিগারেট ধরান চাই। আবার ধোঁয়া ছাড়ার কত রকম কায়দা। নাক-মুখ দিয়ে। হাসি লাগে দেখে। মজিদ বলল, আনিস, আমাকে একটা ট্রাফিক পুলিশ দাও দেখি। আরে বাবা, সিগারেটের কথা বলছি।
বুঝেছি। বুঝেছি, তোমার এইসব ঢং ছাড় দেখি।
বৃষ্টির বেগ মনে হয় একটু কমেছে। হা-হা করে বাতাস বইছে ঠিকই। মজিদ বলল, জাফর মড়ার মতো ঘুমুচ্ছে, দেখেছেন হুমায়ূন ভাই!
হেঁটে অভ্যেস নেই তো, টায়ার্ড হয়ে পড়েছে।
টায়ার্ড না হাতি, জাফর হচ্ছে কুম্ভকর্ণের ভাতিজা। হেভি ফাইটিং-এর সময়ও দেখবেন মেশিনগানের ওপর মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে।