আজহার চিঠি খুলে পড়লেন। চিঠিতে লেখা——
যুথী,
আমার ছেলে শুভ্ৰ বিপদে পড়েছিল। তাকে তুমি সাহায্য করেছি। তার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। সামান্য কিছু ফল পাঠালাম। গ্রহণ করলে খুশি হব।
ইতি
শুভ্রর মা।
আজহার বললেন, শুভ্ৰটা কে?
সালমা বললেন, জানি না কে।
তুমি তার মা। তুমি কিছুই জানো না?
আমাকে না বললে জানব কীভাবে?
তুমি অতি মুর্থ একজন মহিলা। মূর্থিশ্রেষ্ঠ। মেয়ের সঙ্গে মায়ের থাকবে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক। যেন মেয়ে পেটে কথা রাখতে না পারে। রাতে এক বিছানায় মা-মেয়ে শোবে। মেয়ে গুনগুন করে সব কথা বলবে। তুমি সময়মতো আমাকে জানাবে। তা-না, সন্ধ্যা হতেই ঘুম। বুদ্ধির কোনো নাড়াচাড়া আমি তোমার মধ্যে দেখলাম না। অপদার্থ মেয়েছেলে!
গালাগালি করছি কেন?
গালাগালি করছি কারণ গালাগালি তোমার প্রাপ্য। চিঠি পড়ে তো আমার গায়ের রক্ত পানি হবার উপক্রম হয়েছে। শুভ্ৰ মহাবিপদে পড়েছে, এমনই বিপদ যে উদ্ধারের পর তার মা একগাদা ফল পাঠিয়েছে। আর উদ্ধার কে করেছে? তোমার মেয়ে। আমি নিশ্চিত ড্রাগঘটিত কিছু! শুভ্র ড্রাগ চালাচালিতে পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছিল। তোমার মেয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে হাতে-পায়ে ধরে তাকে ছাড়িয়ে এনেছে। তোমার মেয়ে তো কথার রানি। ও কি তার ঘর তালা দিয়ে গেছে?
হুঁ।
এইটাও তো একটা কথা, যখনই বাইরে যাবে ঘর তালা দিয়ে যাবে কেন? এমন কী আছে ঘরে যা কেউ দেখতে পারবে না? আমি তালা খোলার লোক নিয়ে আসছি। তালা খুলে আজ তার ঘর চেক করা হবে।
তোমার শরীরটা খারাপ! শুয়ে থাকে। অন্য কোনোদিন তালা খোলা হবে।
আজহার শার্ট পরতে পরতে বললেন, এইসব জিনিস দেরি করতে নাই। কুইক অ্যাকশানে যেতে হয়। শরীর খারাপের আমি কেঁথা পুড়ি।
ইন্টারভিউ বোর্ডে সাধারণত বেশ কয়েকজন থাকেন। এখানে বোর্ডে একজনই আছেন। মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। সুন্ট-টাই পরা না। হালকা সবুজ রঙের টিশার্চ পরা। ভদ্রলোকের চুল কোঁকড়ানো। চেহারা সুন্দর। তাঁর সামনে কোনো ফাইলপত্র নেই। আছে কোনো একটা গল্পের বই। ইন্টারভিউ নেওয়ার চেয়ে গল্পের বই পড়ার ব্যাপারে তার আগ্ৰহ বেশি দেখা যাচ্ছে। কথাবাতাঁর ফাঁকে ফাঁকে তিনি বইও পড়ছেন। তাঁর নাম আহসান। তিনি চিকেন ফেদার কোম্পানির সৰ্বেসৰ্ব্ব। চেয়ারম্যান সাহেবের ঘরটাও খুব সুন্দর। দেয়ালে তিনটা পেইনটিং। প্রতিটাই সুন্দর। একটা পেইনটিং-এ গ্রামের মেয়ে ঘোমটা দিয়ে তাকিয়ে আছে। এটা এত সুন্দর যে যুথীর চোখ বারবার সেখানে চলে যাচ্ছে।
আহসান বললেন, বিএসসি অনার্স পাশ করেছেন। রেজাল্টও বেশ ভালো। প্রথম শ্রেণী। এমএসসি শেষ করলেন না কেন? কারণটা কি আর্থিক?
জি।
অনার্সে সাবজেক্ট কী ছিল?
ম্যাথমেটিকস।
ইন্টারেস্ট্রিং।
ইন্টারেস্টিং কেন?
মেয়েরা সাধারণত অঙ্কের দিকে যায় না। তারা সাইকোলজি, সাহিত্য, এইসব পড়ে। মেয়েদের ছোট করার জন্যে বলছি না। এটাই জেনারেল ট্রেন্ড। ভুল বললে সরি।
যুথী বলল, স্যার ভুল বলেন নি।
ভদ্রলোক বললেন, বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল ছিলেন অঙ্কের ছাত্র। তাঁর নাম জানেন?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভেরি গুড। তাঁর কোনো বই পড়েছেন?
দুটা বই পড়েছি—পুতুল নাচের ইতিকথা আর জননী। আমার এক বান্ধবী আছে, তার নাম নীপা। সে খুব বই পড়ে। নীপা যেসব বই আমাকে পড়তে দেয়, আমি তা-ই পড়ি।
আপনি যদি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল নাম বলতে পারেন, আমি আপনাকে চাকরি দিয়ে দেব। বলতে পারবেন?
নাম বলতে না পারলে চাকরি পাব না?
যুথী বলল, এই চাকরির সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক কী?
কোনো সম্পর্ক নেই। এই মুহূর্তে আমি উনার একটা বই পড়ছি বলে এরকম সিদ্ধান্ত নিলাম।
যুথী বলল, উনার আসল নাম প্ৰবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
কনগ্রাচুলেশনস।
ভদ্রলোক বোতাম টিপলেন। এবার সুন্ট-টাই পরা একজন ঢুকলেন। আহসান বই থেকে মুখ না তুলে বললেন, জহির, এই মেয়েটির নাম যুথী। সে আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করছে। অফিস এক্সিকিউটিভ। অ্যাপিয়েন্টমেন্ট লেটার ইস্যু করার ব্যবস্থা করুন।
জয়েনিং ডেট কবে স্যার?
সামনের মাসের এক তারিখ।
জহির যুথীর দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাডাম আসুন আমার সঙ্গে।
যুথীর সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। এটা কেমন চাকরির ইন্টারভিউ? এত বড় একটা কোম্পানি চলবে খামখেয়ালিভাবে? যুথী কী জানে বা জানে না। এই সম্পর্কে এরা তো কিছুই জানে না। বর্তমান সময়ের কাজের প্রধান যে বিষয় কম্পিউটার জানা তাও সে জানে না। ইংরেজিতে সে খুবই কাঁচা। কারও সঙ্গে ইংরেজিতে কথাবার্তা চালানো তার জন্যে অসম্ভব ব্যাপার।
জহির বলল, ম্যাডাম! এইটা আপনার রুম। একটু অগোছালো আছে। আজ দিনের মধ্যেই গুছিয়ে দেওয়া হবে। আপনার পার্সেনাল অ্যাসিসটেন্টের নাম গফুর। সে বিরাট ফাঁকিবাজ। তাকে সবসময় ধমকের ওপর রাখবেন।
আমার আগে এখানে কে বসতেন?
শর্মি ম্যাডাম বসতেন। উনি ছিলেন কম্পিউটারের জাদুকর। যে-কোনো প্রবলেম নিমিষে solve করতে পারতেন।
উনার চাকরি কি নেই?
গত মাস থেকে তাকে অফ করা হয়েছে।
কেন?
ম্যাডাম জানি না কেন! চা খান, চা দিতে বলি?
বলুন।
আমি দশ মিনিট পর কাগজপত্র রেডি করে নিয়ে আসব।
যুথী তার ঘরে বসে আছে। ঠান্ডা ঘর। এসি চলছে। বিজবিজ করে এসির শব্দটা এমন অদ্ভুত লাগছে। যুথীর এখন মনে হচ্ছে, এটা কোনো স্বপ্ন। মাঝে মাঝে সে নিখুঁত স্বপ্ন দেখে। একবার স্বপ্নে দেখল, বাসে করে যাচ্ছে। তার পাশেই বুড়োমতো এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের কোলে পাঁচ-ছয় বছরের একটা মানসিক প্রতিবন্ধী ধরনের মেয়ে। সে হা করে আছে। তার মুখ থেকে ক্রমাগত লালা পড়ছে। মেয়েটা ই ই ই করে শব্দ করছে এবং লালা মাখানো হাত দিয়ে যুথীকে ধরার চেষ্টা করছে। অতি বাস্তব ধরনের স্বপ্ন।