যুথী খেতে বসেছে। সালমা বললেন, তুই কি তোর বাবার মানিব্যাগ থেকে কোনো টাকা নিয়েছিস? পাঁচশ টাকার হিসাব মিলছে না।
যুথী বলল, মা, আমি আমার নিজের খরচ টিউশনির টাকায় করি। তোমাদের কাছ থেকে একটা পয়সা নেই না।
সালমা বললেন, তোর বাবার তো সব হিসাবের টাকা। হিসাব না করলে সংসারও চালাতে পারত না। একটা মানুষ হিসাব করতে করতে বুড়ো হয়ে গেল। তার কোনো শখ মিটাল না, আহাদ মিটাল না।
যুথী বলল, পুরনো ঘ্যানঘ্যাননি বন্ধ করো তো মা! বুদ্ধি হবার পর থেকে তোমার এই ঘ্যানঘ্যাননি শুনছি।
সালমা চুপ করে গেলেন।
রাত দশটায় টিফিন কেরিয়ার ভর্তি খাবার পাঠাল নীপা; আজহার দ্বিতীয়বার খেতে বসলেন। আনন্দে তার চোখমুখ ঝলমল করতে লাগল। তিনি কয়েকবার বললেন, টুনু বাড়িতে থাকলে মজা করে খেত। মিস করল। বিরাট মিস।
টুনু আজহারের বড় ছেলে। সে দেশের বাড়িতে গেছে ধান-চালের ভাগ আনতে।
স্বামীর সঙ্গে সালমাও খেতে বসেছেন। একটা খাবার মুখে দিয়ে বললেন, মাছ কিন্তু মিষ্টি মিষ্টি লাগছে।
আজহার বললেন, কথা না বলে আরাম করে খাও তো। হাই ক্লাস ফুড় মিষ্টি মিষ্টি হয়। লোয়ার লেবেল ফুড হয় ঝাল। এমন ঝাল যে মুখে দেওয়া যায় না। যুথী মা! সব কি ঘরের রান্না?
যুথী বলল, খাবার এসেছে হোটেল সোনারগাঁ আর হোটেল রেডিসন থেকে।
আজহার বললেন, বললাম না হাই ক্লাস ফুড! যুথী মা, তুইও বোস। মাংসের এই আইটেম অসাধারণ হয়েছে।
যুথী বলল, প্রতিটি কথার শুরুতে একবার করে যুথী মা বলবে না। শুধু যুথী ডাকবে।
আজহার বিস্মিত গলায় বললেন, নিজের মেয়েকে মা ডাকতে পারব না!
যুথী বলল, বাবা খাও তো। কথা বন্ধ।
যুথী বাবা-মার খাওয়া দেখছে। তাদের এক রাতে দ্বিতীয়বার খেতে বসা এবং আনন্দের সঙ্গে খাওয়ার দৃশ্য দেখে হঠাৎ তার চোখে পানি এসে গেল। চোখের পানি গোপন করার জন্যে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।
শুভ্র বাথরুম।
হাট শাওয়ার নিচ্ছে। তার মা রেহানা বাথরুমের বাইরে তোয়ালে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। রাগে তাঁর শরীর জ্বলে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে রাগ সামলে রেখেছেন। ছেলে নানান ঝামেলার ভেতর দিয়ে গিয়েছে। এখনো রাতের খাবার খায় নি। খাওয়া শেষ হোক। তাকে কঠিন কিছু কথা আজ রাতে শুনতেই হবে, তবে এখন না।
রাথরুমের দরজা সামান্য খোলা। শুভ্র কখনোই বাথরুমের দরজা বন্ধ করে না। ছোটবেলায় একবার বাথরুমের দরজা বন্ধ করে আর খুলতে পারে নি। দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করা হয়। সেই থেকে তার ভেতর ভয় ঢুকে গেছে।
শুভ্ৰ, মাথায় শ্যাম্পু দিয়েছ?
হুঁ।
মাথায় গরম পানি দিয়ো না।
আচ্ছা।
যে মেয়েটা তোমাকে উদ্ধার করেছে তার নাম যেন কী? তুমি একবার বলেছ। আমি ভুলে গেছি।
যুথী।
মিডল ক্লাস ফ্যামিলি নেম।
নাম থেকে ক্লাস বোঝা যায় মা?
অবশ্যই বোঝা যায়। যুথী, বকুল, পারুল, এইসব ফুলের নামে নাম হয় লোয়ার মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে।
শুভ্ৰ কি খুব হাই ক্লাস নাম মা?
তোমার গায়ের রঙ দেখে তোমার নাম দিয়েছিলাম শুভ্ৰ।
ওরাও হয়তো তাই করেছে। ফুলের মতো স্বভাব দেখে ফুলের নামে নাম রেখেছে।
যুথী মেয়েটার স্বভাব ফুলের মতো?
উঁহু। খুব রাগী। আমাকে কঠিন গলায় গালি দিয়েছে! আমাকে বলেছে, মানসিক প্রতিবন্ধী, গাধামানব।
তুমি চুপ করে গালি শুনলে?
হ্যাঁ। আমি নিশ্চয়ই তাকে গালি দেব না। মা, মেয়েটার গলার স্বর অস্বাভাবিক মিষ্টি।
গলার স্বরের টক মিষ্টি বুঝা শিখলে কবে থেকে?
তুমি রাগ করছ না-কি মা?
তোমার খাটের ওপর টাওয়েল রাখলাম। আমি টেবিল সাজাতে বলছি। তুমি খাবার টেবিলে চলে এসো।
আচ্ছা।
শুভ্ৰর বাবা মেরাজউদ্দিন সাহেব খাবার টেবিলে ছেলের জন্যে অপেক্ষা করছেন। তার হাতে এই সংখ্যা National Geographic, গ্লোবাল ওয়ামিং-এর ওপর একটা লেখা ছাপা হয়েছে। মন দিয়ে পড়ছেন। শুভ্র ঘরে ঢুকতেই তিনি পত্রিকা বন্ধ করলেন এবং বললেন, সারা দিন তোমার ওপর দিয়ে অনেক ঝামেলা গিয়েছে শুনেছি। কীভাবে উদ্ধার পেয়েছ তাও শুনেছি। তোমাকে কিছু উপদেশ দেওয়া প্রয়োজন, তবে খাবার টেবিল উপদেশ দেওয়ার Forum না।
শুভ্র বলল, কেমন আছ বাবা?
মেরাজউদ্দিন বললেন, ভালো আছি। বেশির ভাগ সময় আমি ভালো থাকি। তোমার মা বেশির ভাগ সময় তোমার চিস্তায় অস্থির থাকেন। আজ তোমার কোনো খবর না পেয়ে তার প্রেসার নিচেরটা একশ দিশে চলে গিয়েছিল।
শুভ্ৰ বলল, বাবা! তোমার গাড়িটা ওরা পুড়িয়ে ফেলেছে। সরি ফর দ্যাট।
মেরাজউদ্দিন বললেন, সরি হবার কিছু নেই। গাড়ির সবরকম ইনস্যুরেন্স করা আছে। গাড়ির প্রসঙ্গ থাকুক। যে মেয়েটির জন্মদিনে অনিমন্ত্রিতভাবে ভাবে উপস্থিত হয়েছিলে, তাকে আ ভোরবেলা একটি উপহার পাঠাবে। আর যে মেয়েটি তোমাকে সাহায্য করেছে, তাকেও একটা উপহার পাঠাবে।
শুভ্ৰ প্লেটে খাবার নিতে নিতে বলল, এটা তো বাবা সম্ভব হবে না। বাসায় ফেরার সময় গাড়িতে বসে ছিলাম। বড় গাড়ি, যুথীদের বাড়ির গলিতে ঢোকেনি। ওদের বাড়িটা চিনি না।
যে বাড়ি থেকে গাড়িটা এসেছে সে বাড়িটা চিনবে না?
না।
মেরাজউদ্দিন খাবার মুখে দিতে দিতে বললেন, তারপরেও মেয়ে দুটির ঠিকানা বের করা সম্ভব।
রেহানা বললেন, কীভাবে সম্ভব?
মেরাজউদ্দিন বললেন, মাতা-পুত্র দুজনে মিলে চিন্তা করো কীভাবে সম্ভব?
রেহানা বললেন, শুভ্ৰ যদি কিছু মনে করতে না পারে এবং মেয়ে দুটির টেলিফোন নাম্বার যদি তার কাছে না থাকে তাহলে কোনোভাবেই সম্ভব না। শুভ্ৰ, তোমার কাছে কি ওদের টেলিফোন নাম্বার আছে?