একজন রোগামতো মানুষ যুথীকে বলল, আফা শুনেন, শুভ্ৰ ভাইজানের ক্ষতি যদি কেউ করে তারে আমরা চাবায়া খায়া ফেলব। সে যত বড় নবাবের পুতই হউক।
সবাই সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, অবশ্যই!
একজন বলল, কানা ছালামন্তরে আমরা যদি চাবায়া না খাই তাইলে আমরা পিতামাতার জারজ সন্তান।
আবার হুঙ্কার উঠল, অবশ্যই!
মর্জিনা কোনো আলোচনায় অংশ নিচ্ছে না। সে বাবার কবরের পাশে পাকুরগাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি অপ্ৰকৃতস্থের দৃষ্টি। তার হাত মুঠি করা। সেখানে নীল রঙের একটা ডিম। ডিমটা পাখির। শুভ্ৰ ভাইজানের সঙ্গে মজা করার জন্যে সে বলেছিল সাপের ডিম। ভাইজান তা-ই বিশ্বাস করে ডিমটা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মিথ্যা কথাটা বলার জন্যে মর্জিনার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কান্না আসছে না। ভেতরে ভেতরে মর্জিনা অনেক শান্ত। তার সবকিছু ঠিক করা আছে। নাইলনের দড়ি পর্যন্ত কেনা আছে। শুভ্ৰ ভাইজানের খারাপ খবর পাওয়া মাত্র সে ঝুলে পড়বে।
যুথীর সঙ্গে একটা মোবাইল টেলিফোন সেট আছে। মেরাজউদ্দিন দিয়ে দিয়েছেন। চরে মোবাইল সেটটা কাজ করছে না। কোনো সিগন্যাল নেই। যুথী ঢাকার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছে না। তবে সে জানে না যে মেরাজউদ্দিন হেলিকপ্টার নিয়ে রওনা হয়েছেন। পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মাথায় হেলিকপ্টার চরে নামবে। তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে আসছেন। রেহানা স্বামীর পাশে মূর্তির মতো বসে আছেন। তাঁর দৃষ্টিও অপ্রকৃতস্থ। কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না।
মেরাজউদ্দিন বললেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি তোমার ছেলেকে দেখবে। রেহানা বললেন, আচ্ছা।
তাকে প্রথম কথা কী বলবে ঠিক করেছ?
না।
আমি শিখিয়ে দিব?
দাও।
মেরাজউদ্দিন বললেন, তুমি তাকে বলবে ইউ নিটি বয়।
রেহানা বিড়বিড় করে বললেন, ইউ নটি বয়। ইউ নটি বয়। ইউ নটি বয়।
শুভ্ৰকে লঞ্চের ছাদে আনা হয়েছে। সেখানে কানা ছালামত তার দুই সঙ্গী নিয়ে বসা। তাদের সামনে ইটভর্তি চটের বস্তা! কানা ছালামত বলল, আপনি যে চিঠি লিখেছেন সেটা পড়লাম। চিঠি সুন্দর লিখেছেন। এই অবস্থায় ঠান্ডা মাথায় একটা চিঠি লিখতে পেরেছেন, এটা অনেক বড় ব্যাপার।
শুভ্র বলল, অন্যকে লেখা চিঠি পড়েছেন, কাজটা তো ঠিক করেন নি।
কানা ছালামত বলল, আমার সব কাজই তো বেঠিক।
শুভ্ৰ বলল, ঠিকানা লিখে দিয়েছি। চিঠিটা ঠিকমতো পৌঁছাবেন।
কানা ছালামত হাসল। শুভ্র বলল, আপনার চোখ তো ঠিক আছে, আপনার নাম কানা ছালামত কেন?
কানা ছালামত বলল, নিজেই নিজের নাম দিয়েছি। একেক সময় একেক নাম দেই। আমার আগের নাম ফ্রুট ফোটন। র্যাবের ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হবার পর নতুন নাম কানা ছালামত।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
কানা ছালামত বলল, বুঝতে না পারলে নাই! শুনেন, যাকে চিঠি লিখেছেন সে চরে উপস্থিত আছে। আপনি এক কাজ করেন, নিজের হাতেই তাকে চিঠিটা দেন। সে খুশি হবে।
যুথী চরে এসেছে?
হ্যাঁ।
আপনি তাকে চেনেন?
একসময় চিনতাম।
শুভ্র চমকে উঠে বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি যুথীর বড়ভাই টুলু? এতক্ষণ খেয়াল করি নি, আপনার সঙ্গে যুথীর চেহারার অস্বাভাবিক মিল। আপনার গলার স্বরও যুথীর মতোই মিষ্টি।
কানা ছালামত বলল, আমি কারোর ভাই না। কারোর স্বামীও না। আমি কানা ছালামত। কোষা নৌকা বাইতে পারেন? নৌকা বাওয়া শিখেছেন?
অল্প স্বল্প পারি।
লাঞ্চের সঙ্গে কোষা নৌকা বাধা আছে। নৌকা নিয়ে চলে যান। আমরাও লঞ্চ নিয়ে বিদায় হব। আরেকটা শেষ কথা শুনে যান। যুথীর কাছে লেখা চিঠিটা পড়ে অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছি। করিম আঙ্কেল নামের একটা লোককে গুলি করে মেরে যেরকম আনন্দ পেয়েছিলাম, সেরকম আনন্দ। দুটা সম্পূর্ণ দুরকম জিনিস, কিন্তু আনন্দ একই। এটাই আশ্চর্যের বিষয়। যাই হোক, বিদায়।
শুভ্র বলল, আপনার স্ত্রীর নাম কি লাইলি?
একটু আগে কী বলেছি? আমার কোনো বোন নাই। আমার কোনো স্ত্রীও নাই।
শুভ্র বলল, আপনি যদি না জানতেন যুথীকে আমি চিনি, তাহলে কি আপনি বস্তায় ভরে পানিতে ফেলতে পারতেন?
পারতাম।
শুভ্র বলল, আমার খুব শখ ছিল অতি ভয়ঙ্কর কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলব।
আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, শখ মিটার কথা। মিটে নাই?
শুভ্র বলল, আমি বইতে পড়েছি। সিরিয়াল কিলারদের মানসিক গঠন অন্যরকম। তারা ভালো এবং মন্দ আলাদা করতে পারে না। তাদের মধ্যে পাপবোধের ব্যাপার নেই। আপনারও কি তাই?
টুনু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে তার সঙ্গীকে বলল, শুভ্রকে নৌকায় তুলে দিয়ে লঞ্চ ছাড়ার ব্যবস্থা কর।
শুভ্র বলল, আর পাঁচটা মিনিট আপনার সঙ্গে কথা বলি প্লিজ। আপনি কি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ফর হুম দ্যা বেল টোলস বইটা পড়েছেন? বইটার শুরুতে গীর্জয়া মৃত্যুঘণ্টা নিয়ে একটা কথা আছে।
টুলু সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। তারা শুভ্ৰকে ধরে নিয়ে গেল।
হেলিকপ্টার নিয়ে মেরাজউদ্দিন নেমেছেন। তার স্ত্রীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছেন। যুথী ছুটে এসে তাদের পাশে দাঁড়াল। মেরাজউদ্দিন আনন্দিত গলায় বললেন, চরের লোকজন মাথা কামানো যে যুবকটিকে কাঁধে নিয়ে ছোটাছুটি করছে সে কি আমাদের শুভ্র?
যুখী বলল, জি স্যার।
রেহানা বিড়বিড় করে বললেন, শুভ্ৰ ইউ নটি কয়।
মেরাজউদ্দিন বললেন, রোদে পুড়ে গায়ের রঙ তামার মতো হয়ে গেছে। এখন তার নতুন নাম হওয়া উচিত তাম। রেহানা তুমি বলো, তাম্র ইউনিটি বয়।