টাকার জন্যে মানুষ পারে না। এমন কাজ নাই। তবে আপনেরে সত্য কথা বলি! কাজটা আমি করব না। অন্য একজন করবে। মৃত্যুর আগে মনে কিছু চায়? চাইলে বলেন। তবে এখন যদি বলেন, পোলাও কোর্মা খাব, খাসির রেজালা খাব, তা পারব না। কাঁঠাল খাইতে মন চাইলে খান।
শুভ্ৰ তাকিয়ে আছে। লোকটার কথা এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। কোনো ঠাট্টা-তামাশা নয় তো?
আল্লাখোদার নাম নিতে চাইলে নাম নেন। তওবা করতে চাইলে তওবা করেন। নিজে নিজে তওবা করবেন। মাওলানা দিতে পারব না। অজুর পানি দিতে বলব?
ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনার মুখোমুখি হলে প্রকৃতি ব্যবস্থা নেয়। শরীরে হঠাৎ করেই প্রচুর এড্রেলিন জারিক রস চলে আসে। তখন ভয়ঙ্কর বিষয়টাকেও তেমন অস্বাভাবিক মনে হয় না। শুভ্রর মনে হয় তা-ই হলো। সে স্বাভাবিক গলায় বলল, একটা চিঠি লিখব। চিঠিটা পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। পারবেন?
ব্যবস্থা করা যাবে। চিঠি কারে লিখবেন? পিতামাতাকে?
না। তারা আমার এই চিঠি সহ্য করতে পারবেন না। চিঠিটা লিখব যুথীকে। সে শক্ত মেয়ে আছে, সে সহ্য করতে পারবে।
যুথী কে? আপনার লাভার?
সে আমার প্রেমিকা না। আমার পছন্দের একজন। তার গলার স্বর অস্বাভাবিক মিষ্টি।
তার সঙ্গে সেক্স করেছেন?
শুভ্র বলল, আপনারা যে আমাকে মেরে ফেলবেন সেটা আমি বুঝতে পারছি। মৃত্যুর আগে নোংরা কথা শুনতে ভালো লাগছে না। কাঁঠালের বিচি দিয়ে যে চং ঢং শব্দ করছেন এটাও শুনতে ভালো লাগছে না। আমাকে কাগজ-কলম দিন। চিঠি লেখা শুরু করি।
লঞ্চে চিঠি লেখার মতো কাগজ পাওয়া গেল না। দুটা বলপয়েন্ট পাওয়া গেল। মোবারক কাগজের জন্যে লোক পাঠাল। বস্তার ঝামেলাটা দ্রুত সেরে ফেলতে পারলে ভালো হতো। মোবারক কাজটা করতে পারছে না, কারণ যুথী নামের মেয়েটাকে এই লোক কী লেখে তা তার জানতে ইচ্ছা করছে। সে তার একজীবনে অনেক অদ্ভুত মানুষ দেখেছে। এরকম দেখে নি। ছেলেটিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষীণ ইচ্ছা তার হচ্ছে। ইচ্ছাটাকে সে আমল দিচ্ছে না।
যে কাগজ-কলম আনতে গেছে সে ফিরছে না, তবে লিঞ্চের সারেং-এর ঘরে রুলটোনা একটা খাতার কয়েকটা পাতা পাওয়া গেল। শুভ্ৰ খাতা নিয়ে উবু হয়ে বসেছে। লেখা শুরু করেছে। মোবারক যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে শুভ্রর কাণ্ডকারখানা দেখছে। কী লেখা হচ্ছে তা সে শুভ্রর ঘাড়ের ওপর উঁকি দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।
শুভ্ৰ লিখছে—
যুথী,
রাশিয়ান পাগলা সাধু রাসপুটিন কীভাবে মারা গেছেন জানো? তিনি মারা যান পেট্রোগ্রাডে, যার বর্তমান নাম সেন্ট পিটার্সবার্গ। ১৯১৬ সনে। তাঁকে প্রথমে প্রচুর সায়ানাইড মেশানো মদ এবং কেক খাওয়ানো হয়। তাতে তাঁর কিছুই হয় না। প্রিন্স Felix Yussup০v তখন তাঁর বুকে পিস্তল দিয়ে কয়েকটি গুলি করেন তাতেও রাসপুটিনের কিছু হয় না। বরং রাসপুটিন প্রিন্সের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন। মৃত্যুর কোনো লক্ষণ না দেখে তাঁকে ফেলে দেওয়া হয় Nova নদীতে। তাঁর মৃত্যু হয় পানিতে ড়ুবে। বলতে ভুলে গেছি, তাঁকে চটের থলিতে ভরে পানিতে ফেলা হয়েছিল।
আমার নিজেকে এই মুহূর্তে রাসপুটিনের মতো লাগছে। কারণটা বলছি।
এই পর্যন্ত লিখে শুভ্ৰ মোবারকের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে এক কাপ চ্যা খাওয়াতে পারবেন?
মোবারক বলল, অবশ্যই। দুধ চা না রঙ চা?
শুভ্র বলল, দুধ চা। আপনি একটু দূরে বসতে পারবেন? ঘাড়ের ওপর দিয়ে কেউ তাকিয়ে থাকলে আমি লিখতে পারি না। ভালো কথা, যে বস্তায় ভরে আমাকে পানিতে ফেলা হবে সেটা কি আনা হয়েছে?
সব রেডি। বস্তা, ইট, সব।
যে আমাকে পানিতে ফেলবে তাকে আমার দেখার ইচ্ছা ছিল। তার নাম কী?
তার নাম বলা যাবে না। তবে আপনেরে বলতে বাধা নাই। আপনে তো আর কাউরে গিয়া বলবেন না। সেই সুযোগ নাই। তারে আমরা হায়ার করে এনেছি। তার নাম কানা ছালামত।
একটা চোখ কি নষ্ট?
চোখ ঠিকই আছে, তারপরেও নাম কানা।
শুভ্ৰ বলল, কানা নাম হবার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গল্প আছে। কলেজে সবাই আমাকে কানা বাবা ডাকত। কারণ আমি চোখে কম দেখি। কানা ছালামতের নামের পেছনের গল্পটা কী?
এত কথা বলতে পারব না। চিঠি শেষ করেন। হাতে সময় নাই।
শুভ্র বলল, চা আসুক। চায়ে চুমুক দিয়ে লেখা শুরু করি।
যুথী হেকমতের চায়ের দোকানে বসে আছে। হেকমত তাকে বলল, যার জন্যে এসেছেন তার আশা ছেড়ে দেন। সে ধরা খেয়েছে কানা ছালামতের হাতে।
এতক্ষণে বস্তায় ভাইরা তারে পানিতে নামায়ে দিয়েছে। খেল খতম কইরা সে পয়সা হজম কইরা ফেলছে।
যুথী বলল, ভ্যাজর ভ্যাজার করবেন না প্লিজ।
আপনার পরিচয় কী? আপনি তার কে হন?
আমি তার কেউ হই না। তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে নিতে এসেছি। মজিনা মেয়েটার ঘর কোথায়?
জানি না কোথায়। চর তো ছোট না। বিশাল চর। কোন চিপায় ঘর তুলছে খুঁইজা বাইর করেন।
শুভ্ৰ মহাবিপদে পড়েছে, এই ব্যাপারটা যুথীর কাছে এখন পরিষ্কার। বিপদের ধরনটা বুঝতে পারছে না। সে কার কাছে সাহায্যের জন্যে যাবে তাও জানে না। চরে নিশ্চয়ই থানা-পুলিশ নেই। কানা ছালামত নামের একজন কেউ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কানা ছালামতটা কে? কোথায় তাকে নিয়ে গেছে? সত্যি মেরে ফেলবে? মানুষ মারা এত সহজ?
যুথী হেকমতের দোকান থেকে বের হয়ে মর্জিনার বাড়ি খুঁজে বের করল। চরের সবাই জড়ো হয়েছে সেখানে। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত যুথীর নিজেকে অসহায় লাগিছিল, এখন ততটা লাগছে না। চারের মানুষজন শুভ্রর নিখোঁজ হবার খবর পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছে। তাদের ব্যাকুলতা অবাক হয়ে দেখার মতো।