গলাপানিতে ড়ুইব্যা বইসা থাকেন।
নৌকার আরেক যাত্রী বলল, উনার মধ্য পীরাতি আছে। অনেকেই দেখেছে উনি যখন রাতে হাইট যান। তখন তার পিছনে পিছনে একজন যায়। কে বইল্যা আওয়াজ দিলে সে মিলায়া যায়।
যুথী বলল, আপনি নিজে দেখেছেন?
আমি দেখি নাই, তয় অনেকেই দেখেছে।
যুথী শুভ্রর চরে পৌঁছল ভরদুপুরে। তার ইচ্ছা করছে কী সুন্দর! কী সুন্দর! বলে চিৎকার করে উঠতে। খেলার মাঠের মতো বিশাল সবুজ এক প্রান্তর। নদীর ধার ঘেসে ঘরগুলিকে মনে হচ্ছে খেলনা ঘর। প্রচণ্ড বাতাস। কিছুক্ষণ পর পর তার শাড়ি ফুলে ফুলে উঠছে। নিজেকে মনে হচ্ছে নৌকার পাল।
দুটা বাচ্চামেয়ে হাঁটুপানিতে নেমে কী যেন করছে। যুথী জিজ্ঞেস করল, এই, তোমাদের চারটার নাম কী?
একজন বিরক্ত গলায় বলল, শুভের চর।
যুথী বলল, শুভের চর না। এটার নাম শুভ্রর চর। বলো শুভ্রর চর।
মেয়ে দুটি ফিরেও তাকাল না। তারা খেলায় মেতেছে।
যুথী বলল, সায়েন্সের বক্তৃতা দেয় যে শুভ্র তাকে তোমরা চেনো?
ছোট মেয়েটা বলল, দিক কইরেন না কইলাম।
যুথী হাঁটতে বের হলো। সে ঠিক করেছে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না।
প্রথমে একা একা দ্বীপে চক্কর দেবে। ছোট কোনো ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করবে, তোমাদের এই চরটার নাম কী?
আজ থেকে দেড়শ দুশ বছর পর দেশটা অনেক বদলে যাবে। শুভ্রর চর নামটা কি বদলাবে? মনে হয় না। শুভ্ৰ কে?–এই নিয়ে নানান গল্প তৈরি হবে। উনি বিরাট পীর ছিলেন। জিন পুষতেন। উনি যেখানে যেতেন তার সঙ্গে একটা জিন যেত।
শুভ্ৰ মুগ্ধ হয়ে পাখির বাসা দেখছে। একটা বাসার মা মাছরাঙা তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। মানুষ দেখে সে মোটেও ভয় পাচ্ছে না। ডিম ঢেকে সে বসে আছে বলে ডিমের রঙ দেখা যাচ্ছে না।
আপনের নাম শুভ্ৰ?
শুভ্ৰ চমকে তাকাল। দুজন চোখে সানগ্লাস পরা মধ্যম বয়সী অচেনা লোক। তাদের গায়ে চকচকে শার্ট। রোদোপোড়া চেহারা; দুজনের কেউই মনে হয় কয়েকদিন দাড়ি কামায় নি। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দুজনের একজন কথা বলছে, অন্যজন একটু পর পর গলা খাকারি দিয়ে থুথু ফেলছে।
প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি, জবাব দেন না। কী জন্যে? আপনের নাম শুভ্ৰ?
শুভ্ৰ বলল, হ্যাঁ।
ভালো আছেন?
হ্যাঁ, ভালো আছি।
পক্ষী দেখেন?
হ্যাঁ।
আমাদের সঙ্গে একটু আসতে হবে।
কেন?
কাজ আছে।
কী কাজ?
সেটা যথাসময়ে জানবেন।
আপনাদের সঙ্গে কোথায় যাব?
লাঞ্চে। একটা লঞ্চ পাড়ে ভিড়ছে, দেখেন নাই? লঞ্চের নাম এম এল সকিনা।
শুভ্র বলল, চলুন যাই, তবে মর্জিনাকে একটা খবর দেওয়া দরকার। সে দুশ্চিন্তা করবে।
তারে নিয়া আপনের ভাবার কিছু নাই। নিজেরে নিয়া ভাবেন।
শুভ্র বলল, নিজেকে নিয়ে তো আমি কখনো ভাবি না।
এখন ভাবেন। ভাবনার সময় হয়েছে।
এম এল সকিনা লঞ্চটি একতলা। চর থেকে বেশ কিছুটা দূরে নোঙ্গর করে আছে। শুভ্ৰকে নৌকায় করে সেখানে নেওয়া হলো। লঞ্চের পেছন দিকে ছোট্ট একটা রুমে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। রুমের একটাই জানালা, সেই জানালাও পুরোপুরি খোলা না। সামান্য খোলা। ভেতরটা অন্ধকার। সেখানে পার্টি পাতা। পার্টির ওপর আধশোয়া হয়ে এক লোক। অন্ধকারেও তার চোখে সানগ্লাস। তার নাম মোবারক। মোবারকের সামনে গামলাভর্তি পাকা কাঁঠাল। কাঁঠালের ওপর নীল রঙের বেশ কিছু পুরুষ্টু মাছি। মোবারক হাত দিয়ে মাছি সরিয়ে কাঁঠালের বিচি মুখে দিচ্ছে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খু করে বিচি ফেলছে। বিচিগুলি টিনের বেড়ায় লেগে ঢং করে শব্দ করছে। শব্দটা মনে হয় তার পছন্দ হচ্ছে। প্রতিবারই শব্দ শোনার পর তার মুখ হাসি হাসি হয়ে যাচ্ছে। সে শুভ্রর দিকে না তাকিয়েই বলল, কাঁঠাল খাওয়ার অভ্যাস আছে?
শুভ্ৰ বলল, কাঁঠাল আমার পছন্দ না।
গরিবের খানা, এইজন্যে পছন্দ না?
শুভ্র বলল, ধনী-গরিবের ব্যাপার না। যে খাবার ধনী মানুষ খেতে পারে সেই খাবার গরিব মানুষও খেতে পারে।
লোকটা শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ধনী-গরিবের খানা এক না। খানা ভিন্ন। তবে গু একই। ধনীর গুতে গন্ধ, গরিবের গুতেও গন্ধ। ঠিক বলেছি না?
শুভ্র কিছু বলল না।
লোকটা চোখ থেকে চশমা খুলতে খুলতে বলল, আপনেরে নিয়া প্যাচাল পারার কিছু নাই। আমি প্যাচালের লোক না। কাজের লোক। আমার উপর হুকুম হয়েছে আপনেরো অফ করে দেয়া। এই কাজটা কিছুক্ষণের মধ্যে করব। শেষ মুহুর্তে কিছু মনে চাইলে বলেন। সিগারেট খাবেন?
সিগারেট আমি খাই না। আপনার কথা বুঝতে পারছি না। আমাকে অফ করে দিবেন। মানে কী?
অফ করা বুঝেন না?
না।
ইলেকট্রিক বাত্তি সুইচ টিপলে অফ হয়—এইটা তো জানেন?
জানি। কিন্তু আমি ইলেকট্রিক বাতি না। আমি মানুষ।
আপনেরে বস্তায় ভরে দূরে নিয়ে পানিতে ফেলা দেওয়া হবে। বস্তার ভিতর ইট থাকবে। আপনে শান্তিমতো নদীর তলে ঘুমায়া থাকবেন। কেউ আপনেরে ডিসটর্ব করবে না। আপনেও কাউরে ডিসটর্ব করতে পারবেন না। সাইন্সের বক্তৃতা শেষ। এখন বুঝছেন, অফ করা মানে পানিতে ড়ুইবা মরা? মরলেই অফ। পানিতে ড়ুবলেও অফ, ইটের ভাটার আগুনে পুড়লেও অফ।
আমাকে অফ করবেন কেন?
কারণ আপনে বিরাট ঝামেলার লোক। এই চরের নামই হয়ে গেছে। শুভ্রর চর। আপনেরো অফ কইরা ঝামেলা মিটাইতে হইবে। এই হুকুম।
হুকুম কে দিয়েছে?
তার নাম দিয়া কী করবেন? এখন তৈরি হয় যান।
কিসের জন্যে তৈরি হব?
মরণের জনে।
শুভ্ৰ অবাক হয়ে বলল, যে মানুষটা আপনার কোনো ক্ষতি করে নি তাকে খুন করতে পারবেন?