যুথী বলল, মাছটা তাহলে কাটতে পাঠাই?
আজহার বললেন, এই মাছ আমি কাটিয়ে আনব। ইনসট্রাকশান দিয়ে কাটাতে হবে। রাতে পোলাও করতে হবে। এত বড় মাছ পোলাও ছাড়া জমবে না। পোলাওয়ের চাল ঘরে আছে না কিনতে হবে? ঘরে তো কিছুই থাকে না। মাছটা এনেছে কে?
শুভ্রর বাবা এনেছেন।
বুঝাই যাচ্ছে উনি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। যুথী, ভালোমতো আদর যত্ন কর। আমি সামনে যাব না। পাগল মানুষ, কী বলতে কী বলে ফেলব।
যুথী লক্ষ্য করুল, অনেকদিন পর তার বাবা স্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করেছেন। একটা বড় মাছ পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে।
মেরাজউদ্দিন চা খেতে খেতে যুথীর সঙ্গে গল্প করছেন। যুথী খুবই অস্বস্তিতে পড়েছে, কারণ তাঁকে যে চায়ের কাপটা দেওয়া হয়েছে সেখানে ঠিক চুমুক দেওয়ার জায়গাটা সামান্য ভাঙা। মেরাজউদ্দিন ভাঙাটা সরিয়ে সাবধানে চুমুক দিচ্ছেন। ঘরে ভালো কাপও ছিল। বেছে বেছে এই কাপটাই সে দিল! যুথী বলল, স্যার, আমি আপনার কাপটা বদলে দেই?
মেরাজউদ্দিন বললেন, কাপ বদলাতে হবে না। এই কাপে চা খেয়ে আমি খুবই আনন্দ পাচ্ছি। আনন্দ পাওয়ার কারণটা শুনতে চাও?
চাই।
আমার বাবা ছিলেন স্কুল টিচার। একজন স্কুল টিচারের আর্থিক অবস্থা তো বুঝতেই পার। বাবার জন্যে যে চায়ের কাপটা ছিল, সেটা ঠিক এই জায়গায় ভাঙা ছিল। বাবাকে নতুন কাপ অনেকবার কিনে দেওয়া হয়েছে, তিনি তারপরেও ভাঙা কাপে চা খেয়ে গেছেন। তিনি বলতেন, আমি ভাঙা কপাল নিয়ে জন্মেছি। আমি তো ভাঙা কাপেই চা খাব।
যুথী বলল, তিনি কি আপনার উত্থান দেখে যেতে পেরেছেন?
মেরাজউদ্দিন বললেন, না। তিনি কিছুই দেখে যেতে পারেন নি। মৃত্যুশয্যায় তিনি আমাকে বললেন, উত্তরাধিকারসূত্রে ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু পায়। আমি তোর জন্যে কিছু ঋণ রেখে গেলাম। তুই কিছু মনে করিস না। ঋণ শোধের ব্যবস্থা করিস।
মা, আমি এই কাপে আরেক কাপ চা খাব। এবং যাবার সময় এই কাপটা সঙ্গে করে নিয়ে যাব। সস্তা সেন্টিমেন্টালিটি আমার মধ্যে নেই। বাবার কথা হঠাৎ মনে হওয়ায় নিজের ভেতর খানিকটা স্যাতস্যাতে ভাব চলে এসেছে।
যুথী আরেক কাপ চা নিয়ে এল। মেরাজউদ্দিন বললেন, আমি তোমার কাছে একটা কাজে এসেছি। আমার ছেলে কোথায় আছে, কোন চরে বাস করছে তা তুমি খুঁজে বের করবে এবং তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। আমার ধারণা, তোমার চেয়ে ভালো করে কেউ এই কাজটা করতে পারবে না। মা, ঠিক আছে?
যুথী বলল, আমি আজই রওনা হব। মেরাজউদ্দিন বললেন, ছেলের চিন্তায় তার মা নানান পাগলামি শুরু করেছেন। মাঝরাতে বিছানায় উঠে বসে শুভ্ৰ কই? শুভ্ৰ? বলে চোঁচাতে থাকেন। ঠিক করেছি। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেব।
উনি তার ছেলেকে খুব পছন্দ করেন?
কোন মা তার ছেলেমেয়েকে পছন্দ করে না তুমি বলো দেখি? কোনো ছেলে যদি খুন করে এসে মায়ের পাশে দাঁড়ায়, মা তার মাথায় হাত রাখবেন।
যুথী বলল, বাবা মাথায় হাত রাখবেন না?
মেরাজউদ্দিন বললেন, না। সব সন্তান তার মায়ের অংশ। বাবার অংশ নয়।
শুভ্ৰর চর
রেহানার শরীর ভয়ঙ্কর খারাপ করেছে। রক্তে সুগার ওঠানামা করছে। হার্টবিট মিস করছে। এই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাইগ্রেনের তীব্র যন্ত্রণা। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কড়া সিডেটিভ দিয়ে ডাক্তাররা তাকে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন।
সিডেটিভের ঘুম স্বপ্নহীন হয়। কিন্তু ঘুমের মধ্যে তিনি ভয়ঙ্কর এক স্বপ্ন দেখলেন। কয়েকজন মিলে শুভ্ৰকে বস্তায় ভরে পানিতে ফেলে দিয়েছে। শুভ্র বস্তার ভেতর থেকে ডাকছে, মা! মা!
রেহানা জেগে উঠলেন। বাচ্চামেয়েদের মতো চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমার শুভ্র কোথায়? আমার শুভ্র!
নার্স-ডাক্তার ছুটে এল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ডাক্তার সাহেব, আমার শুভ্ৰকে ওয়া বস্তায় ভরে পানিতে ফেলে দিয়েছে।
তাঁকে পেথিড্রিন ইনজেকশন দিয়ে আবারও ঘুম পাড়াতে হলো।
শুভ্র চরের পাড় ঘেসে হাঁটছে। সে খবর পেয়েছে, একটা মাঝারি সাইজের হিজল গাছে কয়েকটা মাছরাঙা পাখি বাসা বেঁধেছে। ডিম পেড়েছে। শুভ্র যাচ্ছে মাছরাঙা পাখির বাসা দেখতে। পাখির গায়ের রঙের মতো ডিমগুলির গায়েও নাকি রঙ। কয়েকদিন আগে শুভ্র একটা সাপের ডিম পেয়েছে। ডিমের খোসার রঙ হালকা নীল। ভয়ঙ্কর এক সরীসৃপ নীল রঙের ডিম পাড়ছে—ব্যাপারটা অদ্ভুত। শুভ্র সাপের ডিমটা ফেলে নি। খড় দিয়ে পেঁচিয়ে রেখে দিয়েছে।
শুভ্রর সন্ধানে মুন্সিগঞ্জ থেকে যুথী খেয়া নৌকায় উঠেছে। মাঝি বলল, আপা, কই যাবেন? শুভ্রর চর?
যুথী বলল, হ্যাঁ। যার নামে চরের নাম তিনি কি সেখানেই আছেন?
মাঝি বলল, এত কিছু তো আপা বলতে পারব না। চরে নাইম্যা খোঁজ নেন।
নৌকার এক যাত্রী বলল, শুভ্ৰ ভাইজান চরেই থাকেন। আপনি তার কাছে যেতে চান?
হুঁ।
আত্মীয় হন?
না। পরিচিত। উনি মানুষ কেমন?
পাগলা কিসিমের। ভালো মানুষ পাগলা কিসিমের হয়, এইটা আল্লাপাকের বিধান।
উনি কী পাগলামি করেন?
প্রত্যেক শনিবারে বক্তৃতা হয়।
যুথী আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিসের বক্তৃতা?
ছাইনছের বক্তৃতা। যেমন ধরেন গিয়া পিথিমি ভন ভন কইরা ঘুরতেছে। কিন্তুক উত্তর-দক্ষিণে ঘুর্ণা নাই। সবই ছাইনছের কথা।
এইসব কথা শোনার জন্যে সবাই আসে?
যার ইচ্ছা হয় যায়। না গেলে তো কেউ থানা-পুলিশ করবে না।
বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া উনি আর কী করেন?