যমুনা কিছু বলল না। টাকিলার গ্লাসে চুমুক দিল।
মেয়েরা কয়েকটা দলে ভাগ হয়েছে। তিনজনের একটা দল ছাদের এক কোনায় বসেছে। এই দলের প্রধানের নাম নামিরা। সে দুটা ইয়াবা ট্যাবলেট নিয়ে এসেছে। ইয়াবা নেশা করার পদ্ধতি শেখাচ্ছে। একজন বলল, আমি তো জানি গিলে খেতে হয়।
নামিরা বলল, গিলে খেতে চাইলে গিলে খা। আমি কী করছি আগে দেখ! এই ফয়েলে ট্যাবলেট রাখলাম। এখন লাইটার দিয়ে ফয়েলের নিচে আগুন দেব। ট্যাবলেট গরমে গলে যাবে। ধোঁয়া বের হবে। সেই ধোঁয়া নাকে টেনে নিতে হবে। ট্যাবলেট সবসময় নড়াচড়া করতে হবে। এক জায়গায় রাখা যাবে না।
ধোঁয়া নাকে নিলে কেমন লাগবে?
নিয়ে দেখ কেমন লাগে।
ভয় লাগছে তো।
নামিরা বলল, ভয় লাগলে নিবি না।
ট্যাবলেটের নিচে লাইটার দিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। হালকা ধোঁয়া বের হচ্ছে। নামিরা বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে চাপা গলায় বলল, আহ।
করিম আঙ্কেল গ্লাস হাতে সুইমিংপুলের পাশে এসে বসলেন। যমুনা তাঁর সঙ্গে নেই। নীপা এবং তার বন্ধুরা করিম আঙ্কেলকে ঘিরে বসেছে। তিনি গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, মানুষের দশটি প্রধান আনন্দ কী তোমরা জানো?
নীপা বলল, আমরা কিছুই জানি না। আপনি কী জানেন বলুন। করিম আঙ্কেল বললেন, আনন্দের তালিকায় প্রথমেই আছে sex। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করার কিছু নেই। যেটা সত্য সেটা বলতেই হবে। এখন তোমরা বলো, দ্বিতীয় প্রধান আনন্দ কী?
নীপা বলল, গান শোনা?
করিম আঙ্কেল বললেন, হয় নি। দ্বিতীয় প্রধান আনন্দও হলো sex। তৃতীয়ও তাই। চতুর্থ হচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গ। পঞ্চম হলো Food। ষষ্ঠ হলো Music। সপ্তম হলো দৃষ্টিনন্দন বস্তু। অষ্টম হলো Books।
নীপার বন্ধু জয়তী বলল, ভালোবাসা কি কোনো আনন্দের ব্যাপার না?
করিম আঙ্কেল জয়তীর দিকে তাকিয়ে বললেন, My dear child, ভালোবাসা বলে কিছু নেই। ভালোবাসা হচ্ছে এমন একটা শব্দ যা রাজশেখর বসু তাঁর চলন্তিকা ডিকশনারিতে ব্যবহার করেছেন। এর অর্থ তিনি লিখেছেন- প্রীতি করা, কাহারো প্রতি অনুরক্ত হওয়া, পছন্দ হওয়া। ডিকশনারির বাইরে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। তোমরা চাইলে প্রমাণ করে দিতে পারি।
প্ৰমাণ করুন।
একটি শর্তে প্ৰমাণ করব। তোমাদের সঙ্গে আমাকে জলে নামতে দিতে হবে। কি রাজি?
জয়িতা বলল, আমি রাজি। নীপা, তুই কী বলিস?
নীপা বলল, না।
যুথী শুভ্রর সামনে এসে দাঁড়াল। বিরক্ত গলায় বলল, আপনি এখনো বসে আছেন?
শুভ্ৰ বলল, বাসায় একা একা থাকি। কোথাও যাই না। আজ চারদিকে হৈচৈ আর আনন্দ দেখে খুব ভালো লাগছে।
যুথী বলল, আমি বাসায় চলে যাচ্ছি। আসুন আমার সঙ্গে। নীপার গাড়ি আমাকে প্রথমে নামাবে, তারপর আপনাকে নামাবে।
আপনি চলে যাচ্ছেন কেন?
বাসা থেকে টেলিফোন এসেছে, বাবার শরীর হঠাৎ খুব খারাপ করেছে। বুকে ব্যথা। কাজেই চলে যাচ্ছি।
শুভ্র বলল, শ্ৰেষ্ঠ জলনারী প্রতিযোগিতাটা করবেন না? আমার দেখার শখ ছিল কে হয় শ্রেষ্ঠ জলনারী। আমার ধারণা আপনি হতেন।
যুথী বলল, আপনাকে খুব কঠিন কিছু কথা বলার ইচ্ছা ছিল। বলছি না, কারণ আপনার সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হবে না।
শুভ্র বলল, কিছু কঠিন কথা বলুন তো আমি শুনি। আপনার গলার স্বর খুব মিষ্টি তো। আমার জানার শখ মিষ্টি গলায় কঠিন কথা শুনতে কেমন লাগে।
যুথী বলল, আপনি নির্বোধ মানসিক প্রতিবন্ধী একজন মানুষ। গাধামানব সম্প্রদায়ের একজন। আপনার নিজের গাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আপনার তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নাই। আপনি অচেনা এক মেয়ের জন্মদিনের উৎসবে এসে বসে আছেন। শ্ৰেষ্ঠ জালনারী নির্বাচন দেখবেন। ছিঃ!
যুথীর বাবা আজহার ইস্টার্ন ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করেন। ফিল্ড ইন্সপেক্টর। তিনি শোবার ঘরে খাটের ওপর বসা। তার মুখভর্তি পান। হাতে বিড়ি। খরচ কমানোর জন্যে ইদানীং বিড়ি খাওয়া ধরেছেন। তিনি মন দিয়ে টিভিতে একটা নাটক দেখছেন। এক পাগল পুকুরে বাস করে—এই হলো নাটকের কাহিনী। পাগলের কাণ্ডকারখানা দেখে তিনি যথেষ্টই মজা পাচ্ছেন। যুথীকে ঘরে ঢুকতে দেখে তিনি টিভি বন্ধ করে দিলেন। বড় মেয়েকে তিনি বেশ ভয় পান।
যুথী বলল, বাবা! তোমার না শরীর খারাপ?
আজহার বললেন, খারাপ ছিল। এখন ঠিক হয়েছে। হঠাৎ ব্যথা উঠল, ভাবলাম হার্টের কোনো সমস্যা বোধহয়। এখন বুঝছি হার্টের কিছু না। গ্যাস হয়েছিল। গ্যাস বেশি হলে ফুসফুসে চাপ দেয়, তখন ব্যথা হয়।
যুথী বলল, বাবা, তোমার কিছুই হয় নি। আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরানোর জন্যে এই কাজটা করেছ। আমি বারবার বলেছি, রাত এগারোটার মধ্যে ফিরব। নীপা গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দিবে।
যুথীর মা সালমা বললেন, তোর বাবার সত্যি ব্যথা উঠেছিল। এমন ভয় লাগল। পাখা দিয়ে বাতাস করলাম অনেকক্ষণ। ইলেকট্রিসিটি ছিল না তো, এইজন্যে পাখা দিয়ে বাতাস।
যুথী বলল, পাখা কোথায় যে পাখা দিয়ে বাতাস? এই বাড়িতে তো কোনো পাখা নেই। কেন মিথ্যা কথা বলছি মা?
আজহার কথা ঘুরাবার জন্যে বললেন, মা, খেয়ে এসেছিস?
যুথী বলল, আটটার সময় কী খেয়ে আসব? খাবার দিবে। রাত দশটায়।
আজহার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়েকে একটা ডিম ভেজে ভাত দাও। পটলভাজি আছে না? পটলভাজি ভালো হয়েছে। মা যুথী, যাও খেয়ে আসো। পিতামাতা যদি ভুলও করে তারপরেও তাদের উপর রাগ করতে নাই। তবে বুকের ব্যথার ব্যাপারটা মিথ্যা না।