গঙ্গা ভট্টাচার্য বললেন, খাসির মাংসে কোনো আপত্তি নাই।
গঙ্গা ভট্টাচাৰ্য তৃপ্তি করে খেলেন। মুসলমান বাড়ির মাংস রাধা যে অসাধারণ এই কথা কয়েকবার বললেন।
হারুন বলল, খাসির মাংস হিসাবে যা খেয়েছেন তা গরুর মাংস। আপনার জাত চলে গেছে। সেটা কোনো বিষয় না। জীবন যে এখনো আছে, এইটাই বড় কথা। তাড়াতাড়ি চর ছাইড়া ভাগেন। বিরাট মারামারি হবে। আপনি নিরীহ মানুষ। চর দখলের মারামারিতে জীবন দিবেন, এইটা কেমন কথা!
আপনি কি সত্যই আমাকে গরুর মাংস খাইয়েছেন?
আরে না। তামাশা করেছি। আপনারে গরুর মাংস খাওয়ায়ে আমার লাভ কী?
গঙ্গা ভট্টাচাৰ্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
হারুন বলল, সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বিদায় হয়ে যান। মারামারি রাতেই শুরু হওয়ার কথা। তিন-চাইরটা লাশ পড়বে। সবই মুসলমান। একটা হিন্দু লাশ পড়া দরকার। এই ভেবে কেউ আপনার ক্ষতি করতে পারে। যদিও আপনি এখন আর হিন্দু না। গরুর মাংস খেয়ে জাত গেছে। পাবলিক তো এই খবর জানে না।
আপনি না বললেন গরুর মাংস না! আমার সঙ্গে তামাশা করছেন?
হারুন বলল, ব্রাদার, আমি তামাশা করার লোক না।
গঙ্গা ভট্টাচাৰ্য গলায় আঙুল দিয়ে বমি করার অনেক চেষ্টা করলেন। বমি হলো না। তিনি সন্ধ্যার আগেই চর ছেড়ে বিদায় হলেন।
চায়ের দোকানের হেকমত সকাল থেকেই অস্থির বোধ করছে। অস্থিরতার কারণে সে কয়েক কাপ চা খেয়ে ফেলেছে। চায়ের সঙ্গে বিড়ি টানছে। অস্থিরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সে মুখভর্তি পান থাকা সত্ত্বেও চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফেলেছে। অস্থির না হয়ে উপায় কী? তার কাছে খবর আছে আজ বিকালে ঘটনা ঘটবে। এই জাতীয় ঘটনা রাতের আঁধারে ঘটে। আজকেরটা ঘটবে দিনের আলোয়, সবার চোখের সামনে। যাতে সবাই শিক্ষা পায়। শুভ্ৰ নামের মানুষটার নাম আজ খারিজ হয়ে যাবে। চরবাসীদের নামের তালিকায় এই নাম আর থাকবে না।
কাৰ্যসমাধার লোকজন চলে এসেছে। হারুনের লোক। তাদের দুজন হেকমতের দোকানো রঙ চা খেয়ে গেছে। অন্য আরেক পার্টি নাজেল হয়েছে। আকবরের পার্টি। এরা হারুন গ্রুপের সঙ্গে হাঙ্গামায় যাবে, তবে শুভ্রকে বিদায় করার ব্যাপারে আকবর গ্রুপের কোনো আপত্তি নেই। হাঙ্গামা বিকাল থেকে শুরু হবে। মাঝরাতে মোটামুটি একটা মীমাংসা হবে। শুভ্র ছাড়াও আরও কিছু লোকজনের নাম খারিজ হবে। অর্ধেকের মতো বাড়িঘর জ্বলিয়ে দেওয়া হবে। আশা করা যাচ্ছে পরদিন ভোর থেকে সব শান্তিমতো চলবে। হেকমত দোয়া ইউনুস পড়ে যাচ্ছে, তার কোনো ভয় নেই। তারপরেও কিছু বলা যায় না। সে মাছির মতো চারদিকে নজর রাখার চেষ্টা করছে। একটা লঞ্চকে কয়েকবার যাওয়া-আসা করতে দেখা গেছে। এখন লঞ্চটা মাঝনদীতে। চর থেকে অনেক দূরে। লঞ্চে কী ঘটনা কে জানে!
মর্জিনা চা নিতে এল। হেকমত গলা নিচু করে বলল, খবর কিছু জানো?
মর্জিনা বলল, জানি না।
ঘটনা যে ঘটবে সেইটা জানো!
না। চা নিতে আসছি চা দেন। ঘটনা নিতে আসি নাই। ঘটনা নিতে আসলে গ্লাস ভর্তি কইরা গরম ঘটনা নিতাম।
হেকমত বলল, নানান কিসিমের লোকজন চরে ঘুরাফিরা করতেছে।
মর্জিনা বলল, করুক। আপনের সমস্যা কী? আপনের বরং লাভ। আপনের দোকানে আইসা নগদ পয়সায় চা খাবে।
তোমার ভাইজানের খবর কী? সে লেখাপড়া নিয়া আছে। একটা ইংরেজি বই আছে। পড়ে। আর কুট কুট কইরা হাসে। বইটার নাম-মাছির রাজা।
হেকমত বলল, তোমারে একটা ভালো পরামর্শ দিব, শুনবা?
মর্জিনা বলল, না। এই দুনিয়াতে আমি একজনের পরামর্শই শুনব। ভাইজানের পরামর্শ।
হেকমত বলল, বেশিদিন তার পরামর্শ শুনতে পারবা বইলা তো মনে হয় না। ঘটনা ঘটে যাবে। তোমার ভাইজান মইরা চেগায়া পইরা থাকবে।
মর্জিনা স্বাভাবিক গলায় বলল, তখন আপনের সাথে হাঙ্গা বসব। আপনে আমারে পরামর্শ দিবেন। আমারে চা খাওয়াবেন আর পরামর্শ দিবেন। ইচ্ছা করলে ভাইজানের মতো ছাইনছের বক্তৃতাও দিতে পারেন। আমরা আগে বান্দর ছিলাম। পরে মানুষ হইছি–এইসব হাবিজাবি।
মর্জিনা চা নিয়ে চলে গেল। হেকমত বিড়বিড় করে বলল, মাগি তোর উপকার করতে চাইছিলাম। তুই বুঝলি না; তোর নিজের দিনও ঘনাইছে।
শুভ্ৰ নদীতে গোসল করতে যাবে তার প্রস্তুতি চলছে। গায়ে সরিষার তেল মাখা হচ্ছে। মর্জিনা চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে উপস্থিত হলো।
গরম গরম চা খান। চা খায়া নদীতে নামেন। সাঁতার তো শিখছেন। শিখছেন না?
শুভ্ৰ আনন্দিত গলায় বলল, শিখেছি। এখন ডুব সাঁতার ট্রাই করছি।
মর্জিনা নিজের জন্যে সামান্য রেখে চায়ের গ্লাস শুভ্রর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, চরে মনে হয় গণ্ডগোল হইব।
শুভ্র বলল, আসার পর থেকেই শুনছি চরে গণ্ডগোল হবে। হচ্ছে না তো। একবার হয়ে ঝামেলা শেষ হওয়া ভালো।
মর্জিনা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, গণ্ডগোল তো হইবই। আইজ না হইলে কাইল! আমারে নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। চিন্তা আপনেরে নিয়া। আমি যদি আপনের পায়ে ধইরা একটা অনুরোধ করি রাখবেন?
শুভ্ৰ বলল, যে অনুরোধ পায়ে ধরে করতে হয় সেটা অবশ্যই অন্যায় অনুরোধ। এই অনুরোধ আমি রাখব না।
তাইলে কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করেন, তারপর গোসলে যান।
শুভ্ৰ বলল, অংকের গল্প শুনবে? মর্জিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, যা বলবেন তা-ই শুনব। আপনে তো আর পীরিতের গল্প জানেন না। উপায় কী?
শুভ্ৰ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আগ্রহের সঙ্গে বলল, ৩৭ সংখ্যাটা সম্পর্কে বলি। বিস্ময়কর একটি সংখ্যা। এটা একটা প্ৰাইম নাম্বার। প্রাইম নাম্বার কী জানো?