মর্জিনা বিরক্ত গলায় বলল, আপনের কী যে কথা! কবরে হারিকেন জ্বলে এমন কথা কোনোদিন শুনছেন? আপনের মাথা খারাপ। আপনের মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা আসে; আমার তো মাথা খারাপ না। কবরের উপরে হারিকেন। কী যে কথা!
শুভ্রর প্রস্তাব বিরক্ত হয়ে বাতিল করে মর্জিনা হারিকেনে কেরোসিন ভর্তি করে। কাচ পরিষ্কার করে হারিকেন জ্বালায়। তার বাবার কবরে হারিকেন রাখতে রাখতে মনে মনে বলে, বাপজান, ভয় দেখায়ো না গো।
সে বাড়ির উঠানে বসে তাকিয়ে থাকে। বাবার কবরের হারিকেনের দিকে। শুভ্র তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। তারাভর্তি আকাশ। চাঁদ উঠলেই তারাদের ঔজ্জ্বল্য কমে যাবে। তখন অন্য শোভা।
মর্জিনা!
বলেন, কী বলবেন। চা দিতে বলবেন না। ঘরে চায়ের পাত্তি নাই।
শুভ্র বলল, একটা দুরবিন থাকলে ভালো হতো। আকাশের তারা দেখতে পারতাম। আধুনিক দুরবিন আবিষ্কার করেন জ্যোতির্বিদ কেপলার। বেচারার চোখ ছিল আমার চেয়েও খারাপ। দুরবিন দিয়ে তিনি কিছুই পান নি।
মর্জিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, উনার কপালে নাই। উনি কী করব!
শুভ্ৰ বলল, টমাস আলভা এডিসন আবিষ্কার করেছিলেন গ্রামোফোন। বেচারা তাঁর আবিষ্কার করা গ্রামোফোন থেকে কোনো শব্দ শুনতে পান নি। উনি তখন ছিলেন বধির।
মর্জিনা বলল, প্যাচাল বন্ধ করেন। আপনার প্যাচাল শুনতে ভালো লাগে না।
শুভ্ৰ চুপ করে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মর্জিনার মন খারাপ হয়ে গেল। সে ঠিক কথা বলে নি। শুভ্রর প্যাচাল শুনতে তার খুব ভালো লাগে। শুভ্রর আশেপাশে থাকতে ভালো লাগে। তাকে নিয়ে আজেবাজে চিন্তা করতেও ভালো লাগে। রোজ রাতে সে শুভ্ৰকে নিয়ে আজেবাজে চিন্তা করে। সেইসব চিন্তায় শুভ্রর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। চাঁদনি রাতে দুজনে হাতধরাধরি করে নদীতে সিনান করতে যাচ্ছে। সিনানের অংশটাও মর্জিনা চিন্তা করে। এই অংশ ভয়ঙ্কর।
মর্জিনা বারান্দা থেকে উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। এই মুহুর্তে সে একটা জটিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুভ্ৰ যেদিন চর ছেড়ে চলে যাবে সেদিনই সে পাকুড়গাছে দড়ি ঝুলিয়ে ফাঁস নিবে। বাবার কবরের ওপর সে মরে দোল খেতে থাকবে। সিদ্ধান্তটা নেবার পর তার মনের অস্থিরতা অনেকটা কমল। সে শুভ্রর পাশে এসে দাঁড়াল। হালকা গলায় বলল, ভাইজান চা খাবেন?
শুভ্ৰ বলল, তুমি না বললে চা-পাতা নেই!
হেকমতের দোকান থাইকা আইন্যা দিব। দোকান খোলা আছে। আমি চা নিয়া আসি, আপনে আসমানের তারা দেখতে থাকেন।
শুভ্র বলল, চা আনতে হবে না। বসো এখানে, গল্প করি। মর্জিনা বলল, আগে চা নিয়া আসি। তারপর যত ইচ্ছা গল্প করবেন।
হেকমত বলল, রাইতে একলা আসছ চা নিতে, সমস্যা কী?
মর্জিনা বলল, ভাইজানের চায়ের পিয়াসা লাগছে, এইজন্যে আসছি।
হেকমত বলল, পিয়াস তো আমারও লাগছে। অন্য পিয়াস। এর গতি কী?
মর্জিনা বলল, বিয়া করেন। বিয়া ছাড়া এর গতি নাই।
হেকমত বলল, তুমি রাজি থাকলে তোমারে বিবাহ করতে পারি। রাজি আছ?
মর্জিনা বলল, এক শর্তে রাজি আছি।
শর্তটা কী?
মর্জিনা বলল, আপনে আপনের দোকান থাইকা হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করবেন। দূর থাইকা যেন মনে হয় চরের বেওয়ারিশ কুত্তা হাঁটতেছে। এইভাবে আমার বাড়িতে উপস্থিত হইয়া বলবেন, মর্জিনা, তোমারে বিবাহ করতে চাই। আমি সাথে সাথে রাজি হব। কাজি ডাইক্যা বিবাহ। ভাইজান হইব সাক্ষী। আমারে আপনের হাতে তুইল্যা দিব।
হেকমত বলল, পাগলের সাথে রাইতদিন থাকস বইলা তোরও মাথা খারাপ হইছে। যা ভাগ।
চর এলাকায় ভূমি সেটেলমেন্টের কানুনগো এসেছেন চেইন নিয়ে। চর মাপা হবে। সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ। কানুনগোর নাম গঙ্গা ভট্টাচার্য। তিনি চরে নেমেই ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি ঘুষ খান না। একটা ছেড়া দুই টাকার নোটও না। ঘুষ তার কাছে গোমাংসের মতো। তবে তিনি বাড়িতে একটা স্কুল দেবেন বলে মানত করেছেন। সেই উদ্দেশ্যে যদি কেউ কিছু দিতে চায়, তাহলে আলাদা কথা।
চরের বেশ কিছু লোক তার সঙ্গে ঘুরছে। চেইন টানছে। কাজটায় তারা খুবই উৎসাহ পাচ্ছে। গঙ্গা ভট্টাচাৰ্য এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলেন, চরের নাম কী?
কোনো নাম তো নাই। গঙ্গা ভট্টাচার্য বললেন, একটা নাম তো দেওয়া দরকার। আপাতত দিয়ে রাখি। সরকার যদি বদলাতে চায় পরে বদলাবে।
একজন বলল, নাম দেন শুভ্রর চর।
কী বললেন?
শুভ্রর চর।
উপস্থিত সবাই বলল, এটা একটা ভালো নাম হয়েছে।
গঙ্গা ভট্টাচাৰ্য সেটেলমেন্টের খাতায় লিখলেন চরের নাম শুভ্রর চর। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, এই নাম অতি দ্রুত স্থায়ী হয়ে গেল। খেয়াঘাটের মাঝি বলা শুরু করল, নাও ছাড়ে, নাও ছাড়ে, শুভ্রর চর শুভ্রর চর।
জমি মাপামাপির তৃতীয় দিন দুপুরে গঙ্গা ভট্টাচার্যের কাছে হারুন এসে উপস্থিত। হারুন টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছে। কানুনগো সাহেবের সঙ্গে একত্রে দুপুরের খানা খাবে। হারুন বলল, আপনি নিষ্ঠাবান মানুষ খবর পেয়েছি। ছেঁড়া দুই টাকার নোটও নেন না।
গঙ্গা ভট্টাচার্য বললেন, সঠিক খবর পেয়েছেন। ঘুষ এবং গোমাংস আমার কাছে তুল্য মূল্য। তবে স্কুল দিচ্ছি। স্কুলের সাহায্যার্থে যে যা দিবে তাই নিব।
তখন কি মাপ উনিশ-বিশ করবেন?
করব।
একটা ভালো কাজ করতে হলে কিছু মন্দ কাজও করতে হয়। স্কুল দেওয়া বিরাট কাজ।
হারুন বলল, আপনার মতো পুণ্যবান মানুষের সঙ্গে খানা খাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আসেন। দুইজনে মিলে খানা খাই। আমি খানা নিয়ে এসেছি। খাসির মাংস খান তো?