তুমুল হাততালি শুরু হলো। লাইলি লজ্জালজ্জা মুখ করে বসে রইল। আজ সে সাদা একটা লং ফ্রক পরেছে। তাকে দেখাচ্ছে ইন্দ্ৰাণীর মতো। সে বসেছে করিম আঙ্কেলের পাশে। যমুনাকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
স্ক্রিপ্ট পড়া শুরু করার ঠিক আগমুহূর্তে করিম আঙ্কেল একটা টেলিফোন পেলেন; হোটেল লিবীতে তাকে দুই মিনিটের জন্যে যেতে হবে। অতি জরুরি। তার জন্যে ঢাকা থেকে গিফট প্যাকেট নিয়ে একজন এসেছে। প্যাকেটটা দিয়েই চলে যাবে।
হোটেল লবীতে অচেনা এক যুবক দাঁড়ানো। যুবকের মুখ হাসি হাসি। বিনয়ী চেহারা। যুবক বলল, স্যার কেমন আছেন?
করিম আঙ্কেল বললেন, আমি সবসময়ই ভালো থাকি। আমি কি তোমাকে চিনি?
যুবক বলল, আমাকে আপনি চেনেন না। তবে আমার স্ত্রীকে চেনেন। আমার স্ত্রীর নাম লাইলি। আমার নাম টুনু।
করিম আঙ্কেল সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, কোয়াইট ইন্টারেস্টিং। যুবক বলল, পুলিশের ধারণা আমি ক্রসফায়ারে মৃত। ওদের সেই ধারণা দেওয়া হয়েছে। মৃত মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা খুবই ইন্টারেস্টিং। তাই না স্যার?
বুঝতে পারছি না। মৃত মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা আমার নেই। দুই মিনিট সময় নিয়ে এসেছিলাম, এখন আমাকে যেতে হবে; সবাই অপেক্ষা করছে।
যুবক বলল, আপনাকে তো যেতে দেওয়া যাবে না। আপনি আমার ভয়ঙ্কর গোপন তথ্য জানেন।
তুমি কী করতে যােচ্ছ? আপনার যাতে সহজ মৃত্যু হয় সেই ব্যবস্থা করব। আমি পিস্তল নিয়ে এসেছি। আমার লোকজন আপনাকে ঘিরে আছে। তবে আমি আপনার সঙ্গে একটা নোগোসিয়েশনে যেতে পারি।
কী রকম নেগোসিয়েশন?
যুবক বলল, নেগোসিয়েশনের ব্যাপারটা এখানে বলা যাবে না। সুইমিংপুলের কাছে চলুন। লোকজন সেখানে কম আছে। দেরি না করে আসুন। আপনার যে কোনো চয়েস নেই। এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া আপনার উচিত। আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ।
করিম আঙ্কেল ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, সুইমিংপুলটা কোন দিকে?
আসুন, আমি নিয়ে যাচ্ছি।
করিম আঙ্কেল বললেন, আমি একটা বিষয় পরিষ্কার করতে চাচ্ছি। মেয়েমানুষঘটিত কোনো সমস্যা আমার নেই। কোনো মেয়ে যদি আমার কাছে ছুটে আসে তখন না বলি না। কিন্তু আমি কাউকে ডাকি না।
যুবক বলল, লাইলি কেমন আছে স্যার?
করিম আঙ্কেল বললেন, লাইলি ভালো আছে। আমি তার অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ। গুহামানব নামে আমি যে ছবিটি বানাচ্ছি। সেখানে লাইলিকে প্রায় সেন্ট্রাল একটা ক্যারেক্টর দেওয়া হয়েছে। একটা পপুলার হিন্দি গানের চারটা লাইনও সে গাইবে— বাচপানকে দিন ভুলানা দেনা।
যুবক বলল, স্যার চলুন গল্প করতে করতে এগিয়ে যাই। গল্প লম্বা করে আপনার কোনো লাভ হবে না। আপনাকে উদ্ধার করতে কেউ আসবে না। আপনি কি একা একা হাঁটতে পারবেন? নাকি আমি আপনার হাত ধরব?
করিম আস্কেলের ডেডবডি সুইমিংপুলে ভাসছে—এই খবর দলের বাকিদের কাছে পৌঁছল রাত দশটায়। যে পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়েছে সেই পিস্তলটিা ছিল তার হাতে। পাথরচাপা দেওয়া একটা সুইসাইড নোটও পাওয়া গেল। সেখানে লেখা— জীবন সম্পর্কে চূড়ান্ত হতাশায় এই কাজ করতে আমি বাধ্য হচ্ছি। আমার মৃত্যুর জন্যে আমিই দায়ী।
মর্জিনার বাবার কবর
মর্জিনা তার বাবার কবর চালাঘরের উত্তরদিকে দিয়েছে। পাকুরগাছের নিচে। বড় গাছপালার নিচে কবর হওয়া ভালো। গাছ আল্লাহপাকের নাম নেয়। এতে কবরবাসীর গোরআজাবি কমে। এখন তার মনে হচ্ছে, এত কাছে কবর দেওয়া ঠিক হয় নি। সন্ধ্যার পর থেকে মর্জিনার ভয় ভয় লাগে। এক রাতে সে স্পষ্ট দেখেছে, বুড়োমতো এক লোক কবরের ওপর বসে জিকিরের ভঙ্গিতে মাথা দোলাচ্ছে। বুড়োটা যে তার বাবা এই বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ। শুভ্রকে সে ঘটনাটা বলেছে। শুভ্ৰ শব্দ করে হেসেছে।
মর্জিনা বলল, হাসেন কী জন্যে?
শুভ্র বলল, তোমার কথা শুনে হাসি।
মর্জিনা বলল, হাসির কথা কী বললাম?
শুভ্ৰ বলল, যে কবরের ওপর বসে ছিল তার গায়ে কাপড় ছিল?
মর্জিনা বলল, অবশ্যই। লুঙ্গি ছিল। গেঞ্জি ছিল। মাথায় টুপি ছিল।
শুভ্র বলল, ধরে নিলাম তোমার বাবার ভূত কবরে বসা ছিল। সে জামাকাপড় পাবে কোথায়? জামাকাপড়ের তো ভূত হবার সুযোগ নেই।
মর্জিনা বলল, তাইলে আমি দেখলাম কী?
শুভ্র বলল, আকাশে চাঁদ ছিল। চাঁদের আলোয় পাকুরগাছের ছায়া পড়েছে কবরের ওপর। বাতাসে গাছ দুলছে। তোমার কাছে মনে হয়েছে ছায়া দুলছে। তোমার মস্তিষ্ক সঙ্গে সঙ্গে কল্পনা করে নিয়েছে এই ছায়া তোমার বাবা।
মর্জিনা বলল, আপনের মাথা! যদিও সে বলল আপনের মাথা, কিন্তু শুভ্রর যুক্তি ফেলে দিতে পারল না। যতই দিন যাচ্ছে ততই সে মানুষটার কাজকর্ম এবং কথাবার্তায় মুগ্ধ হচ্ছে। প্রতি শনিবার রাতে স্কুলঘরের উঠানে বসে শুভ্ৰ নানান কথা বলে। চারের সবাই মন দিয়ে শোনে। কথাগুলির একটা নামও আছে-ছাইনছের (science) কথা। মেয়েরা এইসব কথা শুনতে যায় না। তবে মর্জিনা যায়। তার ভালো লাগে এবং অস্থির লাগে। অস্থির লাগার কারণ, এই মানুষ সারা জীবন চরে পড়ে থাকবে না। একসময় যেখানকার মানুষ সেখানে ফিরে যাবে। তখন তার কী হবে? চার থেকে তাকে উচ্ছেদ করলে সে যাবে কোথায়? নাটি মেয়ে হয়ে যাবে? পাড়ায় বাস করা শুরু করবে?
মর্জিনা!
বলেন, কী বলবেন।
শুভ্র বলল, একটা কাজ করো, এখন থেকে একটা হারিকেন জ্বলিয়ে কবরের মাঝখানে রেখে দিয়ে। তাহলে আর কোনো ছায়াও দেখবে না, ভয়ও পাবে। না।