যুথীর বাবা আজহারের মাথা পুরোপুরিই গেছে। এখন তাঁকে আনন্দিত এবং সুখী মানুষ বলে মনে হয়। নিজের বাড়ির কাউকেই তিনি এখন চেনেন না। চিনলেও অল্প সময়ের জন্যে চেনেন। বাড়ির মানুষদের অতিথি হিসেবে দেখেন এবং যথেষ্ট আদরষত্ব করেন। গতকাল যুথী দুপুরে বাইরে থেকে ফিরেছে, তিনি মেয়েকে দেখে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
মা, যুথী তো এখনো ফিরে নি। একটু অপেক্ষা করতে হবে। তবে সে চলে আসবে। দুপুরে তার বাসায় খাবার অভ্যাস। মা, তোমাকে চা দিতে বলি। চা খেতে খেতে আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করো। যুথী চলে এলে তার সঙ্গে ভাত খাবে। দুপুরে কেউ আমার বাড়িতে এসে না খেয়ে যাবে তা হবে না। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এলেও একই অবস্থা। তাকেও পার্টিতে বসে আমাদের সঙ্গে খেতে হবে। একেক বাড়ির একেক সিষ্টেম। এটা হলো আমার বাড়ির সিষ্টেম। আমাদের বাড়ির আরেকটা সিষ্টেম হলো-ইলিশ মাছ নিষিদ্ধ। মহাবীর আলেকজান্ডার ইলিশ মাছ খেয়ে মারা গিয়েছিলেন, জানো নিশ্চয়ই? উনার মতো মহাবীরের এই অবস্থা হলে আমাদের অবস্থাটা চিন্তা করো। তবে তোমার যদি ইলিশ মাছ খেতে খুব ইচ্ছা করে তাহলে তার ব্যবস্থাও হবে।
আজহার কাউকে চিনতে না পারলেও ডাক্তার আমিরুল ইসলামকে চিনতে পারেন। তাঁর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছেন এমন ভঙ্গিতে গলা নামিয়ে কথা বলেন। কথাগুলি আমিরুল ইসলাম এবং যুথী দুজনের জন্যেই অস্বস্তিকর। তাঁর মাথায় কী করে যেন ঢুকে গেছে ডাক্তার গোপনে যুথীকে কাজি অফিসে বিয়ে করেছে। ডাক্তারের সঙ্গে তার কথাবাতাঁর নমুনা–
ডাক্তার, তুমি গৰ্হিত অন্যায় করেছ। বিবাহ একটা সামাজিক ব্যাপার। দশজন আসবে, আমোদ ফূর্তি হবে। বাচ্চারা গেট ধরবে; তোমার জুতা লুকিয়ে ফেলবে। তুমি কী করলে? চলে গেলে কাজি অফিসে। ছিঃ ডাক্তার ছিঃ। তোমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে আমার তো আপত্তি ছিল না। হীরার টুকরা ছেলে বলতে যা বুঝায় তুমি তা-ই। যাই হোক, যা হবার হয়েছে। এখন মেয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাও। স্ত্রী থাকবে স্বামীর সঙ্গে। বাবা-মার সঙ্গে না। আমি যুথীকে ডেকে বলে দিচ্ছি। সে যেন ব্যাগ গুছিয়ে রাখে। আজ তুমি যখন যাবে সেও তোমার সঙ্গে চলে যাবে। আমার সেবাযত্ন নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। টুনুর স্ত্রী যা পারে করবে। বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ের সেবা নেওয়া যায় না। তবে ছেলের বৌয়ের সেবা নেওয়া যায়। একটা শাস্ত্ৰকথা শোনো—
মেয়ে হচ্ছে গলার কাঁটা
জামাই বুকের শেল
পুত্র হলো মাথার ছাতা…
বাকিটা মনে আসছে না। মনে আসলে বলব। এখন তোমরা দুজন আমার সামনে দাঁড়াও। দুজনকে একসঙ্গে একটু দেখি। যুথী মা কই? আয় দেখি।
যুথীর ধারণা তার বাবার এই পাগলামিটা অভিনয়। তিনি পুরোপুরি সুস্থ একজন মানুষ। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে তিনি পাগলামির ভান করে যাচ্ছেন। যুথী এই বিষয়ে তার মার সঙ্গে কথা বলেছে। সালমা দুঃখে কেঁদে ফেলেছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, জন্মদাতা পিতাকে নিয়ে এই ধরনের কথা! ছিঃ ছিঃ! পাগল সেজে তার লাভ কী?
যুথী বলল, তাঁর সবচেয়ে বড় লাভ তিনি তাঁর মনের কথাগুলি বলে ফেলতে পারছেন। কেউ কিছু মনে করছে না।
তার মনের কথা কী?
তার মনের কথা হচ্ছে ডাক্তারটার সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়া। পাগল সোজে বাবা ওইদিকেই এগুচ্ছেন।
সালমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, জন্মদাতা পিতার সঙ্গে যে মেয়ে এই ধরনের কথা বলে তার সঙ্গে আমি থাকব না। তোর বাবাকে নিয়ে আলাদা বাসা করব।
যুথী বলল, আলাদা বাসা করার তো দরকার নেই। ভাইয়া তোমাদের জন্যে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে। সেখানে গিয়ে ওঠে। বাবা পাগল সেজেছে, তুমি পাগলি সাজো। পাগল-পাগলির সংসার।
সালমা বললেন, যুথী, তুই আর আমার সঙ্গে কথা বলবি না।
যুথী বলল, আচ্ছা যাও বলব না। শেষ কথাটা শুধু বলি। বাবা পাগল সাজার আইডিয়া কেথেকে পেয়েছে সেটা শোনো। বাবা আইডিয়া পেয়েছে একটা হিন্দি ছবি থেকে। ছবিটা বাবার সঙ্গে তুমিও দেখেছি। আমি নাম মনে করতে পারছি না। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে।
সালমা বললেন, ওই ছবিতে লোকটা একটা খুন করেছিল। খুনের দায় থেকে বাঁচারু জন্যে পাগল সেজেছিল। তোর বাবা কি খুন করেছে?
বাবা খুন না করলেও তার পুত্র শীর্ষ সন্ত্রাসী টুনু সাহেব করেছেন। ওই বিষয়টা ভুলে থাকার জন্যে পাগল সাজা একটা উত্তম পন্থা।
সালমা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে যুথীর গালে চড় বসালেন। তিনি কখনোই তাঁর ছেলেমেয়ের গায়ে হাত উঠান নি। এই প্রথম।
নীপা সফিককে নিয়ে করিম আঙ্কেলের স্ক্রিপ্ট শুনতে উপস্থিত হয়েছে।
আজ সন্ধ্যায় স্ক্রিপ্ট পড়া হবে। হোটেলের একটা হলঘর সেই উপলক্ষে ভাড়া করা হয়েছে। করিম আঙ্কেল কয়েকবার বলেছেন, স্ক্রিপ্ট পড়ার আগে বিশেষ ঘোষণা আছে। সবার জন্যে চমক আছে। চমকটা কী বোঝা যাচ্ছে না।
নীপা লাইলিকে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, করিম আঙ্কেল কি তোমাকে বিয়ে করে ফেলেছে?
লাইলি বলল, না তো!
তাহলে কিসের চমক?
লাইলি বলল, আমি জানি না কিসের চমক। উনার কাজকর্ম তো আগে থেকে কিছু বুঝা মুশকিল।
শ্যাস্পেনের বোতল খুলে অনুষ্ঠান শুরু হলো। করিম আঙ্কেল ঘোষণা করলেন, আজ তার জীবনের একটা বিশেষ দিন। আজ স্ক্রিপ্ট পড়া হবে এবং এই ঘটনা চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যে তিনি বিয়ে করবেন। কনের নাম লাইলি। এই মেয়ে জুইগন্ধা মেয়ে। তার গায়ে জুই ফুলের সৌরভ। বিয়েটা হবে অত্যন্ত দায়সারাভাবে। একজন মাওলানা জোগাড় করা হয়েছে। তার সামনে আমরা কবুল কবুল বলব।