কেন?
আমার ছেলের জন্যে। ভালো কথা, শুনলাম তোমার ভাই তোমার অ্যাকাউন্টে যে টাকা রেখেছে তুমি তা নিতে অস্বীকার করেছ। তার কেনা ফ্ল্যাটেও উঠছ না।
যুথী বলল, আপনি কীভাবে জানেন?
মেরাজউদ্দিন বললেন, ইনফরমেশন গেদার করার আমার অনেক মেকানিজম আছে। দুপুরে কী খাবে বলো। এমন কিছু বলো যা জোগাড় করতে আমার কষ্ট হবে এবং হয়তো জোগাড় করতে পারব না। আমি কতটুক পারি তারও একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে।
যুথী বলল, মানুষকে আপনি আপনার ক্ষমতা দেখিয়ে চমকে দিতে ভালোবাসেন, তাই না?
হয়তোবা।
আপনার ছেলে কিন্তু আপনার মতো হয় নি। সে গিনি সোনা হয়েছে।
গিনি সোনাটা কী?
বাইশ ভাগ শোনা দুই ভাগ তামা।
তার তামার অংশ কোনটা?
যুথী বলল, তার বোকামিটা।
এখনো তো বললে না তুমি কী খাবে? কী খেতে ইচ্ছা করছে?
যুথী বলল, আপনার এখানে আমার কোনো কিছুই খেতে ইচ্ছা করছে না।
কারণ কী?
যুথী বলল, আমি দীর্ঘ সময় আপনার সঙ্গে আছি। আমি আপনার জন্যে একটি আনন্দসংবাদ নিয়ে এসেছি। আমি আপনার মেয়ের বয়েসী, অথচ একবারও আপনার মুখ থেকে মা শব্দটি বের হলো না। এই বিস্ময়ের কারণেই খেতে ইচ্ছা করছে না। যুথী উঠে দাঁড়াল।
মেরাজউদ্দিন বললেন, বোস। বোস বললাম।
যুথী বলল, কী আশ্চর্য, আমাকে ধমকাচ্ছেন কেন?
মেরাজউদ্দিন বললেন, মেয়েকে ধমকানো যায়। তোমাকে মেয়ে হিসাবে গ্রহণ করলাম। You are my daughter that I never had. মা, বলো কী খাবে?
যুথী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, পোলাওয়ের চালের ভাত, টাটকা পুঁটি মাছ ভাজা, সরিষা দিয়ে সজিনা, কৈ মাছের ঝোল, মুগ ডাল।
মেরাজউদ্দিন কিছুটা বিস্ময় এবং কিছুটা আনন্দ নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন। সহজ স্বাভাবিক একটা মেয়ে। প্রায় বিশেষত্বহীন। তবে এই মেয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারে। পরিবেশের সঙ্গে রঙ বদলানোর ক্ষমতা এর অবশ্যই আছে।
যুথী বলল, আপনার ঘড়ির নিচের লেখাটার অর্থ বুঝতে পারছি না।
মেরাজউদ্দিন বললেন, লেখাটার অর্থ একেকজন একেকভাবে করে। তুমি নিজে একটা অর্থ বের করো।
যুথী বলল, মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। আত্মহত্যার অর্থ তার কাছে সময় আটকে যাওয়া।
মেরাজউদ্দিন বললেন, মানুষকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দেয় এমন একটা লেখা আমি কেন ঘরে সাজিয়ে রাখাব? চিন্তা করে আসল অর্থটা বের করো। যেদিন বের করবে সেদিন তোমাকে একটা পুরস্কার দেওয়া হবে।
মেরাজউদ্দিন সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে বাড়ি ফিরেন। বারান্দায় বসে স্ত্রীর সঙ্গে এককাপ চা খান। এই অভ্যাস তাঁর অনেকদিনের। চায়ের এই আসরে শুভ্ৰকে কখনো ডাকা হয় না। মেরাজউদ্দিন মনে করেন চা পানের এই উৎসব শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী দুজনের।
আজ তিনি ঠিক সময়ে ফিরেছেন, কিন্তু চায়ের আসরে বসতে পারেন নি। রেহানার কাছে একজন পীর সাহেব এসেছেন। তিনি নখে তিল তেল দিয়ে কী সব মন্ত্র (বা দোয়াদুরুদ) পাঠ করেন। তখন নখে হারানো ব্যক্তির ছবি ফুটে ওঠে। সে কোথায় আছে কী করছে সবই জানা যায়।
পীর সাহেবের নাম কাশেম কুতুবি। বয়স পঞ্চাশের মতো। মাথার চুল এবং দাড়ি মেন্দি দিয়ে লাল করা। মেন্দি মনে হয় বেশ ভালো জাতের। চুল-দাড়ির লাল রঙ চকচক করছে। তার চোখে ভারী চশমা। গায়ের লেবাস গেরুয়া। পায়ে জুতা বা স্যান্ডেল নেই। মোটা কাঁঠাল কাঠের লাল খড়ম।
কাশেম কুতুবি মেরাজউদ্দিনকে দেখে বললেন, স্যার আমার হলো টেলিভিশন সিস্টেম। পর্দা ছোট, মাত্র আধা ইঞ্চি। কালার নাই। ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট।
মেরাজউদ্দিন স্ত্রীর পাশে বসলেন। শুভ্ৰ বিষয়ে তাঁর সব দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। এখন আদিভৌতিক কর্মকাণ্ড দেখা যেতে পারে।
কাশেম কুতুবি তাঁর বুড়ো আঙুলের নখের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছেন। যদিও ঘরে এসি চলছে, তারপরেও উনার এক অ্যাসিসটেন্ট হুজুরের মাথায় তালপাখা দিয়ে বাতাস করছে।
কাশেম কুতুবি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি। সে ঘন জঙ্গলের মধ্যে আছে।
রেহানা আগ্রহ নিয়ে বললেন, সুন্দরবন নাকি পাৰ্বত্য চট্টগ্রাম?
বলা মুশকিল। পর্দা ছোট তো। সব পরিষ্কার দেখা যায় না। তাছাড়া আমার নিজের চোখেও কিছু সমস্যা হয়েছে। ভালো দেখি না। এইজন্যে চশমা খরিদ করতে হয়েছে।
রেহানা বললেন, ছেলে কি দেশের ভেতরে আছে?
কাশেম কুতুবি বললেন, বর্ডার এলাকায় আছে।
মেরাজউদ্দিন বললেন, বর্ডার এলাকায় আছে। এটা বুঝলেন কীভাবে?
কুতুবি বললেন, আমি নখে যেমন দেখি কিছু আবার ইশারাতেও পাই। বর্ডারের বিষয়টা ইশারাতে পেয়েছি।
মেরাজউদ্দিন বললেন, ইশারায় আর কী পাচ্ছেন?
ছেলে ঘরে ফিরতে চায় না। একটা মেয়ের সঙ্গে তার ভাব-ভালোবাসা হয়েছে। তার সঙ্গে সে সংসার করতে চায়।
মেরাজউদ্দিন বললেন, ঘন জঙ্গলের মধ্যে সে মেয়ে পেল কোথায়?
কুতুবি হাসিমুখে বললেন, মেয়েছেলে সব জায়গায় পাওয়া যায় জনাব। ঘন জঙ্গলে পাওয়া যায়, আবার মরুভূমিতেও পাওয়া যায়।
রেহানা বললেন, তুমি সামনে থেকে যাও তো। তোমার কারণে উনি ঠিকমতো দেখতে পারছেন না।
মেরাজউদ্দিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, কুতুবি সাহেব। ভালোমতো দেখুন। আমার ছেলের সন্ধানদাতার জন্যে পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। পুরস্কারটা নিতে পারেন কি না দেখুন।
মেরাজউদ্দিন বারান্দায় চা খেতে খেতে শুভ্রর চিঠি আরেকবার পড়লেন। বিশেষ কোনো চিঠির পুরো অর্থ ধরতে হলে চিঠিটা তিনবার পড়তে হয়। তিনি দুবার পড়েছেন। আরও একবার পড়তে হবে।