রবীন্দ্রনাথ ফ্ল্যাস খেলতেন না বলে তার সাহিত্যে খানিকটা কবুতরের বাকবাকুম ঢুকে গেছে। কেউ তাঁকে ফ্ল্যাস ধরিয়ে দিলে বাংলা সাহিত্য আরো অনেকদূর যেত। আফসোস!
করিম অঙ্কেল রাত বারোটায় লাইলি কী করছে খোঁজ নিতে এসে দেখেন, সে কুড়ি হাজার টাকা জিতে জম্বি অবস্থায় চলে গেছে। তার হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। অদ্ভুত চোখ করে তাকাচ্ছে।
করিম আঙ্কেল বললেন, যথেষ্ট জিতেছ। আর খেলতে হবে না। চলো আমার সঙ্গে।
লাইলি বলল, আরও কিছুক্ষণ খেলি। প্লিজ।
করিম আঙ্কেল বললেন, না। আজকের মতো যথেষ্ট। এখন তুমি হারতে শুরু করবে। তাই নিয়ম। তুমি হুইস্কি খেয়েছ না-কি? মুখ থেকে গন্ধ বের হচ্ছে।
যখন জিতেছিলাম তখন ওরা ফ্রি হুইঙ্কি খাওয়াচ্ছিল। তাই খেয়েছি।
কয় পেগ খেয়েছ মনে আছে?
না।
করিম আঙ্কেল লাইলির কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে ক্যাসিনো থেকে বের করলেন। বিষয়টা কারও কাছেই অস্বাভাবিক মনে হলো না। লাইলির কাছেও না। ক্যাসিনো থেকে বের হয়েই লাইলি হঠাৎ হড়বড় করে করিম আঙ্কেলের গায়ে বমি করে নেতিয়ে পড়ল। করিম আঙ্কেল বললেন, নো প্রবলেম। করিম আঙ্কেল মানুষটা এত ভালো কেন—এই ভেবে লাইলির চোখ ভিজে উঠল।
করিম আঙ্কেল লাইলিকে নিজের হাতে গোসল করিয়ে দিলেন। টাওয়েল দিয়ে শরীর মুছে বিছানায় শুইয়া দিতে দিতে বললেন, আরাম করে একটা ঘুম দাও। সকালে দেখবে শরীয়-মন দুই-ই ফ্রেশ। তখন জেতার টাকা নিয়ে বের হয়ে একসেট গয়না কিনে ফেলো। তা না করলে জেতা টাকা জুয়াতেই চলে যাবে।
লাইলি বিড়বিড় করে বলল, আপনি কি চলে যাচ্ছেন?
করিম আঙ্কেল বললেন, হ্যাঁ। আমার দায়িত্ব শেষ।
লাইলি বলল, আপনি যাবেন না। আপনি চলে গেলে আমার ভয় লাগবে। আমি একা ঘুমাতে পারি না।
তাহলে অবশ্যই থাকব। তোমাকে পাহারা দেব। ভালো কথা, তোমাকে একটা খবর দেওয়া হয় নি। নীপা জানিয়েছে তোমার হাসবেন্ড টুনু মারা গেছে।
লাইলি কী যেন বলল, পরিষ্কার বোঝা গেল না।
করিম আঙ্কেল লাইলির পিঠে হাত রেখে বললেন, তুমি ঘোরের মধ্যে আছ বলেই খবরটা এখন দিলাম। মৃত্যুকে সহজভাবে নিতে হবে লাইলি। মৃত্যু হলো জীবনেরই অংশ। বুঝতে পারছ?
হুঁ।
মৃত্যু আছে বলেই জীবনকে আমরা তিলেতিলে অনুভব করব। জীবন কী? জীবন হলো একগ্লাস শ্যাস্পেন। আমরা বেঁচে আছি মানে আমরা শ্যাম্পেন্ন খাচ্ছি। যখন তলানিতে এসে যাব তখনই মৃত্যু। মৃত্যু থাকার কারণেই শ্যাম্পেন পানের প্রতিটি মুহুর্তকে আনন্দময় করে রাখতে হবে। হবে না?
মনে রাখতে হবে, এ জগতে আনন্দই সত্য, আর সব মিথ্যা। আমার সঙ্গে বলো, আনন্দই সত্য আর সব মিথ্যা।
লায়লী বিড়বিড় করে বলল, আনন্দই সত্য, আর সব মিথ্যা।
করিম আঙ্কেল বললেন, তোমার মন ঠিক করার জন্যে এখন অন্য প্রসঙ্গে আলাপ করি। করব?
হুঁ।
কারও গায়ে থাকে পদ্মের গন্ধ। তাদেরকে বলে পদ্ম নারী। কারও গায়ে থাকে বাসি বকুল ফুলের গন্ধ। এরা হলো বকুলগন্ধা। একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, তার গায়ে ধুতরা ফুলের গন্ধ। ভয়ঙ্কর অবস্থা! এখন তুমি কি জানতে চাও তোমার গায়ে কিসের গন্ধ?
জানতে চাই। আমার গাঁ শুকে বলে দিন।
করিম আঙ্কেল বললেন, ব্যাপারটা এত সহজ না। আগামী সাতদিন তুমি গোসল করবে। সাবান ছাড়া। চুলে শ্যাম্পু দেবে না। গায়ে কোনো সেন্ট বা লোশন। ব্যবহার করবে না। তখনই তোমার গায়ের আসল গন্ধ ফুটে বের হবে। এবং আমি বলে দেব। আমার নাক কুকুরের নাকের চেয়েও শার্প। এখন ঘুমিয়ে পড়।
লাইলি ঘুমিয়ে পড়ল।
যুথী মেরাজউদ্দিন সাহেবের অফিসে এসেছে। বিশাল অফিস। অনেক লোকজন কাজ করছে। সেই তুলনায় মেরাজউদ্দিন সাহেবের অফিসঘর ছোট। তাঁর সামনে একটি মাত্র চেয়ার। একজন ছাড়া দ্বিতীয় দর্শনার্থীকে তিনি সম্ভবত সাক্ষাৎ দেন না। ঘরে দেখার মতো জিনিস একটাই। প্ৰকাণ্ড একটা ঘড়ি; ঘড়ির সেকেন্ডের শব্দটাও শোনা যাচ্ছে। ঘড়ির নিচে লেখা–
You can stop time
If you really want to stop.
যুথীর কাছে লেখার অর্থটা পরিষ্কার হচ্ছে না। —তুমি চাইলেই সময় আটকাতে পার, যদি তা সত্যিকার অর্থেই চাও।
মেরাজউদ্দিন বললেন, তোমার নাম যুথী?
যুথী বলল, জি।
তোমাকে তো আমি আসতে বলি নি। তুমি কি কোনো বিশেষ কারণে এসেছ?
যুথী বলল, আপনারা কি শুভ্রর খোঁজ পেয়েছেন?
সে তার মাকে একটা চিঠি লিখেছে। চিঠিটা পাঠিয়েছে আমার ঠিকানায়। আমি চিঠিটা নিয়ে এসেছি।
চিঠিতে সে কোথায় থাকে তা কি লেখা আছে? কোনো ঠিকানা কি দিয়েছে?
না। তবে আমি ঠিকানা বের করে ফেলেছি।
কীভাবে বের করলে?
খামে মুন্সিগঞ্জ পোষ্টাপিসের ছাপ আছে। শুভ্ৰ লিখেছে সে থাকে এক বিশাল চরে। আমার ধারণা মুন্সিগঞ্জের আশেপাশে পদ্মায় যেসব নতুন চর জেগেছে, সেখানে খোঁজ করলেই তাকে পাওয়া যাবে।
মেরাজউদ্দিন বললেন, তুমি স্মার্ট মেয়ে, তবে শুভ্ৰ যে চিঠি তার মাকে লিখেছে সেই চিঠি তুমি পড়লে কেন?
যুথী বলল, চিঠির সঙ্গে আমাকে লেখা একটা চিরকুট ছিল। সেখানে লেখা আমি যেন তার মার চিঠিটা পড়ি। স্যার, আমি কি চিঠিটা আপনাকে দেব?
দাও।
মেরাজউদ্দিন সাহেবের সামনে চিঠি রেখে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে যুথী বলল, স্যার আমি উঠি?
না। তুমি বসবে এবং আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করব। এটা আমার অর্ডার।
যুথী বলল, আপনার অর্ডার মানতে বাধ্য এমন কেউ তো আমি না।
মেরাজউদ্দিন বললেন, অবশ্যই তুমি আমার অর্ডার মানতে বাধ্য। পুলিশ যখন তোমাকে অ্যারেক্ট করে নিয়ে গেল, তখন আমি তোমাকে উদ্ধার করি। নয়তো রিমান্ডের ঝামেলায় পড়তে। তোমার সবকিছু আমি জানি। আমি স্পাই লাগিয়ে রেখেছিলাম।