মর্জিনা এসে পাশে বসল। শুভ্র বলল, তোমার বাবার অবস্থা কী?
মর্জিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, বাঁচব না।
শুভ্র বলল, সামান্য জ্বরে মানুষ মারা যায়?
মর্জিনা বলল, জ্বরে কেউ মরে না, মৃত্যুরোগে মরণ হয়। ঘরের ভিতরে আজরাইল ঢুইক্যা পড়ছে।
শুভ্র বলল, কী বলে এইসব?
হামাগুড়ি দিয়া ঢুকছে। পরিষ্কার দেখছি। বাপজানের দিকে চাইয়া হাসছে। তারপরে চৌকির নিচে চইলা গেছে। এখন সে অপেক্ষায় আছে।
শুভ্র বলল, তোমার মাথা সামান্য খারাপ আছে মর্জিনা।
মর্জিনা বলল, আপনের সঙ্গে যে ভাইবোন পাতাইছি, বাপজানের মৃত্যুর পর সব শেষ। তখন আপনে আমার আর ভাই না।
আমি কে?
আপনি পুরুষমানুষ। আর কিছু না।
এর মানে কী?
এর মানে আপনে জানলে জানেন, না জানলে নাই। খিচুড়ি নামান, খিদা লাগছে।
মাত্ৰ বসিয়েছি, এখনো চাল ফুটে নাই।
ভাইজান, একটা গল্প করেন। গল্প শুনি।
কী গল্প শুনতে চাও?
পীরিতের গল্প। ভাব-ভালোবাসার গল্প।
ভাব-ভালোবাসার গল্প তো সেইভাবে আমি জানি না।
আপনে কোনোদিন ভাব-ভালোবাসা করেন নাই?
না।
মর্জিনা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যে-কোনো একটা গল্প বলেন।
ভারচুয়াল রিয়েলিটির গল্প শুনবে?
সেইটা আবার কী?
শুভ্র বলল, বিষয়টা যথেষ্টই জটিল, আমি চেষ্টা করব সহজভাবে বোঝাতে। আমার ধারণা তুমি মন দিয়ে শুনলেই বুঝবে। কারণ তুমি অতি বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে।
শুভ্র গল্প শুরু করেছে। মর্জিনা মন দিয়েই শুনছে, তবে তার দৃষ্টি শুভ্রর দিকে না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিজলি চমকাচ্ছে, সে তাই দেখছে। বিদ্যুৎচমকের সময় আকাশে নানান নকশা তৈরি হয়। এইসব নকশায় অনেক ইশারা থাকে। ইশারায় আল্লাহপাক অনেক কিছু বলেন। আক্কেলমন্দ মানুষরা সেটা ধরতে পারে।
শুভ্র বলছে, প্রথমেই একটা বিষয় বুঝতে হবে–তা হলো বাস্তবতা, ইংরেজিতে যাকে বলে Reality। আমি উঠানে বসে খিচুড়ি রান্না করছি। তুমি সামনে বসে আছ। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তোমার এবং আমার কাছে এটা রিয়েলিটি। তুমি যদি আগুনে হাত দাও, হাত পুড়ে যাবে। এটাও রিয়েলিটির অংশ। আবার তুমি যখন স্বপ্ন দেখ, সেটাও রিয়েলিটি। স্বপ্নে আগুনে হাত দিলে ব্যথার অনুভূতি হবে।
এখন কথা হচ্ছে, দুটি রিয়েলিটির কোনটি সত্য? না-কি এই দুই রিয়েলিটির বাইরে কিছু আছে? আমরা বড় কোনো রিয়েলিটির অংশ? এমন কি হতে পারে যে, আমরা কম্পিউটার প্রোগ্রাম ছাড়া কিছুই না? একজন মাস্টার প্রোগ্রামার আমাদের তৈরি করেছেন। আমাদের জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ দিচ্ছেন। আমরা বিষয়টি বাস্তব ভেবে আনন্দ পাচ্ছি। আসলে পুরোটাই একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম। প্রোগ্রামার আমাদের জন্যে ভারচুয়াল রিয়েলিটি তৈরি করেছেন।
মর্জিনা বলল, বকবকানি বন্ধ করেন তো ভাইজান। ভাত সিদ্ধ হইছে কি না দেখেন। হওয়ার কথা।
মর্জিনা উঠে গেল। দুটা প্লেট নিয়ে এল। ঘিয়ের কৌটা আনল। চায়ের চামচে দুচামচ ঘি খিচুড়িতে ছেড়ে দিয়ে প্লেট ধুতে বসল।
তারা খাওয়া শুরু করামাত্র বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। মর্জিনা বলল, যেখানে বইসা আছেন বইসা থাকেন। খাওয়ার মাঝখানে জায়গা বদল করতে নাই। জায়গা বদল করলে রিজিক কমে।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খাব?
হুঁ।
তোমার সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা।
মর্জিনা বলল, আপনার নিজের কথাও অদ্ভুত। অদ্ভুতে অদ্ভুতে কাটাকাটি।
ভালো বৃষ্টি শুরু হয়েছে। থালার ওপর বৃষ্টির পানি পড়ছে। মর্জিনা নির্বিকার। সে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে হা করে বৃষ্টির পানিও খাচ্ছে। শুভ্র খাওয়া বন্ধ করে মর্জিনার কাণ্ড দেখছে।
ঘরের ভেতর থেকে ইয়াকুবের গলা শোনা গেল। ভীত গলা।
ও মার্জিনা! মজিনা কই? মর্জিনা!
মর্জিনা বলল, আমি উঠানে ভাত খাই।
ইয়াকুব বলল, তুফানে তো বাড়িঘর উড়ায় নিয়া যাইতেছে।
মর্জিনা বলল, তুফানের বংশও নাই। বৃষ্টি পড়তাছে। চুপ কইরা শুইয়া থাকেন, আসতেছি।
এক্ষণ অয়।
খাওয়া শেষ কইরা আসব।
বাড়িঘর সব তো উড়ায় নিয়া যাইতেছে। শেষে ঘরচাপা পইড়া মরব। তাড়াতাড়ি আয়, চৌকির নিচে বইসা থাকি।
মর্জিনা বলল, আপনের ইচ্ছা করলে আপনে চৌকির নিচে বসেন।
মর্জিনার কথা শেষ হবার আগেই খুব কাছে কোথাও বজ্ৰপাত হলো। কঠিন নীল আলোয় মর্জিনার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মর্জিনা বলল, কী ভয়ঙ্কর!
শুভ্র বলল, বিজলির এক ঝলকানিতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ থাকে তুমি জানতে চাও?
মর্জিনা বলল, না।
সে খাওয়া শেষ করে ঘরে ঢুকে দেখে, ইয়াকুব চৌকির নিচে। তার বসার ভঙ্গি হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরের মতো। শুধু মুখ হা হয়ে আছে। তার শরীরে প্ৰাণ নেই।
মর্জিনা বলল, বাবা, চৌকির নিচ, থাইকা বাইর হন।
কোনো উত্তর এল না। মৃত মানুষরা জীবিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না। তাদের আলাদা সমাজ।
যুথী এসেছে নীপাদের বাড়িতে
অনেকদিন পর যুথী এসেছে নীপাদের বাড়িতে। নীপা তাকে সরাসরি শোবার ঘরে ডাকল। নীপার ঘুম পুরোপুরি কাটে নি। সে বাসিমুখে এককাপ ব্ল্যাক কফি খেয়েছে। এখন খাচ্ছে গ্ৰীন টি। এতেও ঘুম যাচ্ছে না। নীপার গায়ে পাতলা চাঁদর; চাঁদরের ভেতর দিয়ে তার নগ্ন শরীর দেখা যাচ্ছে।
নীপা বলল, কাল রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে ছিলাম। ভূতের ছবি দেখেছি। বাতি জ্বালিয়ে আমি ঘুমুতে পারি না। ভয়ে নিভাতেও পারি না। ঘুম এসেছে ভোর পাঁচটায়। এই কারণে এখন পর্যন্ত ঘুমাচ্ছি। যুথী, কয়টা বাজে?