শুভ্র তাঁর ঘরে। চৌকিতে উপুড় হয়ে বসে সে চিঠি লিখছে। তার সামনে দুটা হারিকেন। একটা হারিকেনের আলোয় তার দেখতে সমস্যা হয়। পাশের ঘরে ইয়াকুব কাতরাচ্ছে, তাতে তার চিঠি লেখায় অসুবিধা হচ্ছে না।
মা,
তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি, কিন্তু এই চিঠি পাঠাতে পারব না। যেখান থেকে লিখছি সেখানে পোষ্টঅফিস নেই। সেটা সমস্যা না। নৌকায় করে মুন্সিগঞ্জ সদর পোস্ট অফিসে যাওয়া যায়। সমস্যাটা হচ্ছে, আমি তো তোমাদের বাড়ির ঠিকানা জানি না। ঠিকানা জানার প্রয়োজন কখনো হয় নি। বিশাল এসি গাড়িতে সারা জীবন ঘোরাঘুরি করেছি।
মা! আমি আনন্দে আছি। অন্য ধরনের আনন্দ। কী রকম বুঝিয়ে বলি।
মনে করো প্ৰচণ্ড গরম পড়েছে। লু হওয়ার মতো বইছে। ধুলি উড়ছে। গা দিয়ে স্রোতের মতো ঘাম বের হচ্ছে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ একসময় আকাশের এককোণে কালো মেঘ দেখা গেল। সবার মধ্যে সে কী উত্তেজনা! আসছে, বৃষ্টি আসছে। যখন বৃষ্টি নামে কী যে শান্তি! প্রথমদিনের বৃষ্টির আনন্দে আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। চরের ছেলেমেয়েরা (বলতে ভুলে গেছি, আমি চরে বাস করি) একসময় কাদায় গড়াগড়ি করা শুরু করল। আমিও তাই করলাম। গাভর্তি কাদা নিয়ে নদীতে মহিষের মতো শরীর ড়ুবিয়ে বসে রইলাম। কী শান্তি! কী শান্তি!
মা! তুমি কি উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের Lord of the Fies উপন্যাসটা পড়েছ? মনে হয় পড় নি। বাবা পড়েছেন। একদল শিশু নির্জন দ্বীপে উপস্থিত হয়। একে একে তাদের চরিত্র প্রকাশিত হতে থাকে। আমি খুব কাছ থেকে গোল্ডিং সাহেবের উপন্যাস দেখছি। ফিজিক্সে ল্যাবরেটরি আছে। সাহিত্যে কোনো ল্যাবরেটরি নেই। এই প্রথম আমি সাহিত্যের ল্যাবরেটরি দেখছি এবং মজা পাচ্ছি।
মানুষের চরিত্রের অন্ধকার সবসময় প্রকাশিত হয় না। হঠাৎ হঠাৎ প্রকাশিত হয়। তার জন্যে বিশেষ পরিস্থিতির প্রয়োজন হয়। চর হচ্ছে সেই পরিস্থিতি। আমার কাছে হচ্ছে, আমি একটা virtual জগতে ঢুকে গেছি। কিছুই না জেনে আমি এই জগতের একজন observer।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় observer অতি গুরুত্বপূর্ণ। রিয়েলিটি অবজার্ভারনির্ভর। আমি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
অনেক জটিল জটিল কথা লিখে ফেললাম। এখন হালকা কথা। আমাদের দ্বীপের মানুষের খুব মন খারাপ। কেন জানো? কারণ দ্বীপে কোনো পাগল নেই। একজন উন্মাদ না-কি তার হতভাগ্যের কারণে অন্যের ভাগ্য নিয়ে আসে। আমরা সবাই একজন পাগলের জন্যে অপেক্ষা করছি। বাইরে থেকে পাগল আনলেও চলে, তবে নিজেদের পাগল থাকলে সবচেয়ে ভালো হয়।
মা! এখন গানবাজনার আসর বসেছে। যে গান করছে তার নাম কল্লাকাটা। এই অদ্ভুত নামের কারণ হচ্ছে সে কথায় কথায় মানুষের কল্লা কেটে ফেলতে চায়। কল্লাকাটার গলা সুন্দর। শুনেছি আগে অনেক সুন্দর ছিল। প্রচুর গাজা খাবার কারণে গলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কল্লাকাটা শুধু যে গান করে তা না, সে আবার গীতিকারও। নিজেই গান লিখে, নিজেই সুর দেয়। আমাকে নিয়ে সে বেশ কয়েকটা গান লিখেছে। তার একটার কথা এরকম—
ধলা মিয়া করবে বিয়া
নয়া পাড়ায় গিয়া
ঘাট থাইকা কইন্যা তুললাম
মুন্সিগঞ্জে গিয়া।
মুন্সিগঞ্জের কইন্যা সুন্দর
সুন্দর তাহার আঁখি
তারে দেখলে মন উদাস
যেন কোকিল পাখি।
ধলা মিয়া বড়ই ধলা
কন্যা হইলেন কালো
ধলা-কালা মিলনেতে
জগৎ হইবে আলো…
বিশাল গান। পুরোটা মনে নেই; ধলা মিয়া আমার নাম। সবাই আমাকে ধলা মিয়া ডাকে। কেউ কেউ ডাকে মাথা ছিলা ধলা মিয়া। মাথা কামিয়েছি তো-এইজন্যে।
মা, তোমাকে চিঠিটা পাঠানোর বুদ্ধি বের করেছি। তোমার বাড়ির ঠিকানা ভুলে গেলেও যুথীর ঠিকানা মনে আছে; এবং খাতায় লেখাও আছে।
মা, আমার জন্যে ব্যস্ত হয়ে না। আমি একটা experiment শুরু করেছি। তার ফলাফল দেখতে চাই।
কয়েকদিন আগে স্বপ্নে দেখলাম। M.Sc. পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। আমি থার্ড ক্লাস পেয়েছি।
খারাপ হলো কেন? চেয়ারম্যান স্যার বললেন, শেকসপিয়ার থেকে চারটা প্রশ্ন এসেছিল। তুমি সবকটা ভুল আনসার করেছি।
আমি বললাম, স্যার, আমি তো ফিজিক্সের ছাত্র।
চেয়ারম্যান স্যার বললেন, তুমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্ৰ। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, যাও পাগলাগারদে ভর্তি হয়ে যাও।
স্যারের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন বদলে গেল। আমি দেখলাম, আমি একটা পাগলাগারদে বসে আছি। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন পাগল আছে। এবং এদের সঙ্গে আমার অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমি এই পাগলদের একজনকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছি। ভয়ঙ্করটাইপ একজন মোটামুটি রাজি হয়েছে।
মা, ঘুম পাচ্ছে। আবার ক্ষিধেও লেগেছে। আমি এখন খিচুড়ি রান্না করব। কারণ মর্জিনা তার বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত। তার বাবার শরীর খুবই খারাপ করেছে। যেভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আজ রাতেই মারা যায় কি না কে জানে।
ইতি
তোমার শুভ্র
পুনশ্চ-১ : মর্জিনার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। চিৎকার করে কাঁদছে। মনে হয় তার বাবা মারা গেছেন; আমি খোঁজ নিয়ে আসছি।
পুনশ্চ-২ : না, এখনো বেঁচে আছেন। মাঝখানে অজ্ঞানের মতো হয়ে গিয়েছিলেন বলে ভয় পেয়ে মর্জিনা কাঁদছিল।
চিঠি শেষ করে শুভ্র খিচুড়ি বসাল। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হালকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাস আরেকটু বাড়লে উঠানের চুলা ঘরে চলে যেতে হবে।