উঁহু। এমনিতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তাছাড়া কেউ গায়ে হাত দিলে আমার ভালো লাগে না।
ভালো লাগে না কী জন্যে?
শরীর খুবই ব্যক্তিগত জিনিস। সেটা থাকবে সেভাবেই।
তাও ঠিক। ভাইজান ঘুমান। আমি আপনার কাছে বইসা থাকি।
বসে থাকতে হবে না।
দূরে বইসা থাকব। চিন্তা কইরেন না ভাইজান, শইলে হাত দিব না।
শুভ্ৰ ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল, সে পরীক্ষার হলে বসে আছে। তার হাতে প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছে। ফিজিক্সের বদলে ইংরেজি সাহিত্যের প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন : Write an essay on Tolkien’s Lord of the Rings. সে লেখা শুরু করতে গিয়ে দেখল, চশমা আনতে ভুলে গেছে। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
মর্জিনা গ্লাস নিয়ে হেকমতের চায়ের দোকানো গিয়েছে। গ্লাস ভর্তি করে চা নিয়ে আসবে। ঘুম ভাঙলে সে ভাইজানকে গরম গরম চা দেবে। হেকমতের দোকানের চা ভাইজানের পছন্দ।
গ্লাসে চা ঢালতে চালিতে হেকমত বলল, তোমার যে ভাই ধলা মিয়া সে কেমন ভাই?
মর্জিনা বলল, ভাই যেমন হয় তেমন।
তারে পাইলা কই?
আচানক ঘটনা। শুনলে শাইলের লোম খাড়া হয়া যায়। শুনতে চান?
চাই। একদিন সইন্ধ্যাকালে বিরাট ঝড় উঠছে! এমন ঝড় আমি আমার জন্মে দেখি নাই। গাছের ডাল ভাইঙ্গা পড়তাছে। শুরু হইছে বৃষ্টি। হঠাৎ দূরে ঠাড়া পড়ল। ঠান্ডার শব্দের সাথে ধূপুস কইরা এক শব্দ। তাকায়া দেখি, আসমান থাইক্যা চাউলের বস্তার মতো কী জানি পড়ছে। কাছে গিয়া দেখি মানুষ। আমি বললাম, আপনি কে? মানুষটা বলল, আমি তোমার ভাই। আমার নাম মাথা ছিলা ধলামিয়া। এই হইল ঘটনা।
হেকমত বলল, তুমি পাজি মেয়েছেলে। তোমারে যে বিবাহ করবে, তার কপালে দুঃখ আছে।
মর্জিনা বলল, কথা সত্য। এই কারণে ঠিক করেছি। বিবাহ করব না। অন্যরে দুঃখ দিয়া লাভ কী?
মর্জিনা উঠতে যাচ্ছিল, হেকমত বলল, বসো। এক কাপ চা খাও, দাম লাগবে না। মাগনা।
মর্জিনা বসল। তার ঠোঁটের কোনায় হাসি। চেষ্টা করেও সে হাসি গোপন করতে পারছে না।
হেকমত বলল, হাসো কেন?
আপনার ভাব দেইখা হাসি। আপনার ভাব ভালো না। অনেকদিন মেয়ে মাইনষের শইলের গন্ধ না পাইলে পুরুষের যেমন অবস্থা হয় আপনের তেমন অবস্থা।
তুমি তাহলে ভাবও বোঝ?
পুরুষের ভাব বুঝে না এমন মেয়েছেলে আল্লাপাক পয়দা করেন না।
তুমি তো অন্যের পয়সায় ভালো সংসার পাতছ। গাইগারু কিনতেছ শুনলাম।
মর্জিনা বলল, গাইগরু কিনব না। মহিষ কিনব। মহিষের বাথান দিব।
হেকমত বলল, গরু, মহিষ না কিনাই ভালো। হারুন সাব যখন ধাক্কা দিব তখন গরু মহিষ নিয়া পালাইতে পারবা না।
পালাইতে না পারলে আপনেরে দিয়া যাব। খবর পাই, আপনে উনার প্রিয় লোক। আপনেরে তো ধাক্কা দিব না।
চ্যাটাং চ্যাটা কথা কই শিখেছ? তোমার ভাইজানের কাছে?
মর্জিনা বলল, উঠি। চা শেষ।
হেকমত বলল, চায়ের তিয়াস লাগলে চইল্যা আসবা। চা খায়া যাবা। তিয়াস চাইপা রাখা ঠিক না।
মর্জিনা বলল, বিরাট জ্ঞানের কথা বলেছেন গো। তিয়াস চাইপা রাখা ঠিক না। আপনেও চাইপা রাইখেন না। উত্তর চরে নটিবেটিরা কয়েকটা চালাঘর তুলছে। সেইখানে যান। চায়ের দোকানের লাভের কিছু টাকা দিয়া আসেন।
সন্ধ্যার পর এখানে গানের আসর বসে। একজনই গায়ক-কল্লাকাটা। তার গলায় সুর আছে। তবে হাঁপানির টান উঠলে গান এলোমেলো হয়ে যায়। সে গান থামায় না। হাঁপানির টান কমানোর চেষ্টা করে। শ্রোতারা কেউ কিছু মনে করে না।
কল্লাকাটা গানের সময় ডান পায়ে নুপুর পরে নেয়। পা ঝাঁকিয়ে তাল দেয়। হারমোনিয়াম আছে, হারমোনিয়াম বাজানোর লোকও আছে। ঢোলবাদক বেশ কয়েকজন আছে। তারা টিনের ক্যানাস্তারায় বাড়ি দিয়ে তাল দেয়। শুভ্ৰ গানের দলকে ঢোল, বেহালা এবং নতুন হারমোনিয়াম কেনার টাকা দিয়েছে। সামনের শুক্রবারে মুন্সিগঞ্জ থেকে বাদ্যযন্ত্র কেনা হবে।
গানের আসর তেমন জমছে না। হারুন এসে ঘুরে গেছে—এই আতঙ্কেই সবাই অস্থির। বোঝাই যাচ্ছে চরে মারামারি শুরু হবে। কখন হবে সেটাই কথা। হারুন জেলে ছিল, অল্প কিছুদিন হলো ছাড়া পেয়েছে। সে এমপি সাহেবের আপনা লোক—এটাই সমস্যা।
চরে মিটিং করে এমপি সাহেব নিজে বলেছিলেন, চর দখলের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। লাঠি যার চর তার—এই পুরনো স্লোগানে আমরা বিশ্বাস করি না। পদ্মা যাদের জমি কেড়ে নিয়েছে শুধু তারাই জমি পাবে। আর কেউ না। বিলিব্যবস্থা আমি নিজে দেখব। যেন কোনো বিশ্ব বলয়ান হয় তার জন্যে চর এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ির ব্যবস্থা হয়েছে। আসুন ফ্লেন্দাভেদ ভুলে আমরা সবাই একত্রে হয়ে সোনার বাংলা গড়ি।
সেই সাংসদ এখন উল্টে গেছেন। পুলিশ ফাঁড়ি উঠে গেছে। এমপি সাহেবের পেয়ারা আদমি হারুন কিছু লোকজন নিয়ে চর মেপে বেড়াচ্ছে। চরে দখল পাওয়া অর্ধেকের মতো মানুষকে উঠে যেতে বলা হয়েছে।
বাবু নলিনী বসাকের নেতৃত্বে একদল চরের মানুষ মাননীয় সাংসদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। মাননীয় সাংসদ ব্যস্ত বিধায় সাক্ষাৎ হয় নি। (পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই সাংসদ কোন দলের? আওয়ামী লীগ না-কি বিএনপি? অঁদের আশ্বস্ত করছি, যে দলেরই হোক জিনিস একই। গুণগত মানের কোনো উনিশ-বিশ নেই। আওয়ামী ভাবধারার পাঠকরা ধরে নিন সাংসদ বিএনপির। বিএনপি ভাবধারার পাঠকরা ধরে নিন সাংসদ আওয়ামী লীগের।)
রাত আটটা। ইয়াকুবের জ্বর আরো বেড়েছে। মর্জিনা তার মাথায় পানি ঢালছে। এলাকায় কোনো ডাক্তার নেই, একমাত্র ভরসা হুজুরের পানিপড়া এবং প্যারাসিটামল ট্যাবলেট। ইয়াকুবকে প্যারাসিটামল ট্যাবলেটও খাওয়ানো যায় নি। কারণ দোকান বন্ধ।