তিনটা মাছ ধরার কথা। শেষ মুহূর্তে তিন নম্বর মাছ ধরা পড়ল। ফলি মাছ। মাছ ছোট, কিন্তু তার প্রাণশক্তি দেখার মতো। শুভ্ৰ মুগ্ধ হয়ে মাছের ঝাঁপাঝাঁপি দেখে বড়শি খুলে মাছটা ছেড়ে দিল।
মর্জিনা নৌকায় উঠতে উঠতে বলল, ভাইজানের বিষয় কী? বর্শেল হইছেন কবে? শেষপর্যন্ত মাছ ধরছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
শুভ্র বলল, মাছ মারার বিষয়টা খুবই এনজয় করছি। চিন্তা করার সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হলো ছিপ ফেলে বসে থাকা। দুই ধরনের ছিপ ফেলতে হবে, মাছের ছিপ এবং চিন্তার ছিপ। মাছের ছিপে মাছ ধরা পড়বে। চিন্তার ছিপে চিন্তা।
মর্জিনা বলল, আপনার পাগলা কথা কিছুই বুঝি না। আইজ চিন্তা কইরা কী পাইছেন?
শুভ্র বলল, আজ চিন্তা করে পেয়েছি চরে কারও আলাদা করে কিছু থাকবে না। এখানে সবকিছুই সবার। অনেকগুলি নৌকা থাকবে। নৌকায় মাছ ধরা হবে। নৌকাও সবার, মাছের মালিকানাও সবার। ফসল যা হবে সেখানেও সবার সমান ভাগ। কমিউনিস্টটাইপ চিন্তা।
মর্জিনা বলল, পাগলা চিন্তা বাদ দেন। আপন দুই ভাই একত্রে থাকতে পারে না। সবে মিল্যা একত্রে থাকবে! নদীতে একটা ড়ুব দিয়া মাথা ঠাণ্ডা কইরা আসেন। মাছ নিয়া যাইতেছি, নিজের হাতে মাছ রানব। দেখি আমার ভাইজানের মাছের সোয়াদ কেমন। নদীর ভিতরে বেশিদূর যাইয়েন না। সাঁতার জানেন না কিছু না। ড়ুইব্য মরবেন।
শুভ্র বলল, সাঁতার শিখে ফেলব মর্জিনা। অনেকখানি শিখেছি। মাথা ড়ুবিয়ে দুই মিনিট ড়ুবে থাকতে পারি। মাথা তুললেই পারি না।
শুভ্ৰ নদীতে নেমে গেল। তার মনে হলো, স্রোতে গা ভাসানের আনন্দের কাছে সব আনন্দই তুচ্ছ। মাথার ওপরে গানগনে রোদ। নদীর পানি হিমশীতল। নদীতে নেমে শুভ্রর মাথায় আরেকটা চিন্তা চলে এল। তার কাছে মনে হলো নদীগুলি হচ্ছে আটারি। আর সমুদ্র হৃৎপিণ্ড। হৃৎপিণ্ড সচল রাখার জন্যেই নদী।
চরের চায়ের দোকানের চাওয়ালার নাম হেকমত। অতি ধুরন্দর মানুষ। সে একই সঙ্গে হারুনের ঘনিষ্ঠজন এবং ধলা মিয়ার ঘনিষ্ঠজন। চরের বেশ কিছু জমি এখন তার দখলে। সে জমি চাষাবাদ শুরু করেছে। চিনা বাদাম এবং বাঙ্গির বীজ পুতেছে। চারের মাটিতে এই দুই জিনিস ভালো হয়। হেকমতের বয়স চল্লিশের ওপর। এখনো বিয়ে করে নি। সে ঠিক করেছে, জমির দখলের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হলেই বিয়ে করে ফেলবে। চারের জমি হলো বাজারের মেয়েমানুষ। ঘনঘন দখল বদলায়। হেকমত ঠিক করেছে গুছিয়ে বসলে চরের কোনো মেয়েকেই বিয়ে করবে। এরা যন্ত্রের মতো কাজ করতে পারে। বেশ কয়েকটি মেয়ের দিকে তার লক্ষ আছে। এদের মধ্যে মর্জিনাকে তার বিশেষ পছন্দ। মর্জিনার বয়স অল্প, রূপবতী। সে তার বাড়িঘরও সুন্দর করে গুছিয়েছে। মর্জিনার বাপের যে বয়স এবং শরীরের যে অবস্থা তাতে মনে হয় না বেশিদিন টিকবে। তখন মর্জিনার বিষয়ও চলে আসবে তার হাতে। একটাই সমস্যা-ধলা মিয়া। ধলা মিয়ার সঙ্গে মর্জিনার ভাইবোন সম্পর্ক, এটা হেকমত বিশ্বাস করে না। মায়ের পেটের ভাইবোন হলো ভাইবোন। বাকি সব ভাইবোন সেক্সের সুবিধা নেওয়ার ভাইবোন। হেকমত ঘাস কাটা গরু না। সে সব বুঝে। ধলী মিয়াকে চরছাড়া করা বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
পরপুরুষের সঙ্গে বোন সেজে সম্পর্ক যে মেয়ের, তাকে বিবাহ করা কঠিন। তবে এই বিয়েটা সে করবে। স্বার্থের কারণে। মর্জিনা বান্দির মতো সংসারে খাটবে। সংসারের আরো উন্নতি হবার পর সে দেখেশুনে ভালো একটা মেয়ে বিবাহ করবে। সংসার থাকবে সেই মেয়ের হাতে। মর্জিনার পরিচয় হবে বান্দি বউ। চার অঞ্চলে এটা নতুন কিছু না। চর অঞ্চলে একেক পুরুষের তিন-চারটা বউ থাকে। তারও থাকবে। এক বউ হলো সুন্দরের জন্যে। সে সেজোগুজে থাকবে। পায়ে আলতা, চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপষ্টিক। বাকি বউরা হবে কামলা বউ।
হেকমত চুলা নিভিয়ে দিল। ভরদুপুরে কেউ চা খেতে আসে না। ভাত খেয়ে এখন সবাই ভাতম্বুম দিবে। হেকমতের ঘরে ভাত রাধার কেউ নাই। নিজের ভাত তাকে নিজেকেই রাঁধতে হবে।
শুভ্ৰ দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়েছে। দুপুরের খাবার তাকে একা খেতে হয়েছে। মর্জিনার বাবা ইয়াকুব জুরে কাতর। সে ঘরে শুয়ে কাতরাচ্ছে। মর্জিনা বাবার ঘরে উঁকি পর্যন্ত দিচ্ছে না। শুভ্ৰ পার্টি পেতে শুয়েছে পাকুরগাছের নিচে। চারের গাছপালা দ্রুত বড় হয়। পাকুরগাছ ভালোই বড় হয়ে ছায়াদায়িনী বৃক্ষ হয়ে গেছে। সে তার পছন্দের বই চোখের সামনে ধরে আছে। বইটা ভারী। হাত দিয়ে ধরে রাখতে কষ্ট হয়। তার চোখে ঘুম। গরম বাতাস বইছে। ঠান্ডা বাতাসে ঘুম কেটে যায়। গরম বাতাসে ঘুম আসে। অথচ উল্টোটা হওয়া উচিত ছিল।
শুভ্ৰ প্ৰাণপণে চোখ খোলা রাখতে চেষ্টা করছে। বইয়ের লাইনগুলি অস্পষ্ট श्५श् अप्रिाgछ—
Twelve more years passed. Each year the Bagginses had given very lively combined birth dayparties at Bag End; but now it was understood that some thing quite exceptional was being planned for the the Autumn.
ভাইজান! চোখ বন্ধ কইরা বই পড়েন ক্যামনে?
শুভ্ৰ হাত থেকে বই নামাতে নামাতে বলল, চোখ খুলেই বই পড়ছিলাম। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে।
মাথার চুল টাইল্যা ঘুম পাড়ায়া দেই?
শুভ্র বলল, আমার মাথায় চুল কোথায় যে টানবে?
মর্জিনা বলল, তাও তো কথা। পা টিপ্যা দিব?