হঠাৎ শুভ্রর নৌকা দুলে উঠল। ছাতি মাথায় অচেনা একজন নৌকায় উঠে এসেছে। তার থুতনিতে সামান্য দাড়ি। মাথায় কিস্তি টুপি। তার গা থেকে সস্তা আতরের গন্ধ আসছে।
আপনি ধলা মিয়া না?
শুভ্র বলল, জি, আমি মাথা ছিলা ধলা মিয়া।
কী করেন?
মাছ ধরার চেষ্টা করছি।
আপনি কি আমারে চিনেন?
শুভ্র বলল, না। চিনি না।
চরের সবাই আমারে চিনে, আপনি চিনেন না, এইটা কেমন কথা! আমার নাম হারুন, এখন চিনেছেন?
হ্যাঁ, এখন চিনেছি। আমি আপনাকে অত্যন্ত বলশালী কেউ ভেবেছিলাম। আপনি রোগাপাতলা মানুষ ভাবি নি।
হারুন বলল, আপনার মুখের ভাষা ঢাকা শহরের মতো। আপনি কি ঢাকার লোক।
হ্যাঁ, আমি ঢাকার।
ঢাকার লোক চরে কেন?
বোনের সঙ্গে এসেছি।
মর্জিনা আপনার বোন?
জি।
বোনের সঙ্গে আসছেন কী কারণে?
শুভ্র বলল, ভাই বোনের কাছে আসবে না?
হারুন বলল, আসছেন ভালো কথা। কিছুদিন চরের বাতাস খেয়েছেন, এইটাও ভালো। চরের বাতাসে ভাইটামিন আছে। শরীরে ভাইটামিন পড়েছে, এখন বোন নিয়া বিদায় হয়ে যান।
শুভ্ৰ বলল, বিদায় হব কেন? পদ্মায় যাদের জমি চলে গেছে তারাই চরে জমি পেয়েছে। কাগজপত্ৰ দেখিয়ে আমরা দখল নিয়েছি। সরকারি লোক দখল দিয়েছে।
হারুন গলায় ঝুলানো পেতলের খিলাল দিয়ে দাঁত খিলাল করতে করতে বলল, চরে কোনো সরকার নাই। চরে আমরাই সরকার। আমি হুকুম দিলাম, তিন দিনের মধ্যে চর ছাড়বেন। যদি না ছাড়েন কী হবে শুনতে চান?
শুভ্র বলল, শুনতে চাই না, তবে বলতে চাইলে বলতে পারেন।
হারুন বলল, আপনার লাশ পানিতে ভাসবে।
শুভ্রর ছিপের একটা ফাতনা ড়ুবে গেছে। উত্তেজনায় অস্থির হয়ে সে ছিপ টানল এবং বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখল, মধ্যম আকৃতির একটা বোয়াল মাছ বরশিতে বিঁধেছে। মাছটা তার প্রাণশক্তিতে ছটফট করেই যাচ্ছে। সূর্যের আলোতে সে ঝলমল করছে। শুভ্ৰ প্ৰাণপণে চেঁচাল, মাছ ধরে ফেলেছি! মাছ ধরে ফেলেছি!
হারুন বলল, মাছ ভালোই ধরেছেন। এই বোয়ালের নাম কালিবোয়াল, এর স্বাদ অদ্ভুত।
শুভ্ৰ বলল, এই বোয়ালটা আপনি নিয়ে যান।
হারুন বলল, আমি নিয়া যাব? দুই পয়সার বোয়াল দিয়া আমারে খুশি করা যাবে না। আপনারে তিন দিন সময় দিয়েছি, বোয়াল মাছের কারণে এক মিনিট সময় বেশি পাবেন। তিন দিন এক মিনিট। এর মধ্যে আসসালামু আলায়কুম বলবেন।
শুভ্র বলল, এক মিনিট সময় বেশি পাবার জন্যে মাছটা আপনাকে দিতে চাচ্ছি তা না। আমি মাছ ধরে যতটা আনন্দ পেয়েছি, আপনি আমার মাছ ধরা দেখে ততটাই আনন্দ পেয়েছেন। আপনার চোখ ঝলমল করে উঠেছিল, এইজন্যেই দিচ্ছি।
হারুন বলল, আপনি বিরাট চালাক লোক, তবে চালাকিতে কাজ হবে না।
হারুন সিগারেট ধরাল।
শুভ্র বলল, আপনার কথা কি আরও বাকি আছে?
হারুন বলল, কথা যা বলার বলে ফেলেছি। এখন আপনার মাছ ধরা দেখি। হারুনের কথা শেষ হবার আগেই শুভ্রর ছিপে একটা রুই মাছ ধরা পড়ল।
হারুন বলল, ধলা মিয়া! আপনি ভাগ্যবান মানুষ। এই বড়শিতে এত বড় রুই মাছ ধরা পড়ে না। সিগারেট খাবেন?
সিগারেট খাই না। হারুন বলল, আপনি একটা বোয়াল মাছ দিলেন, আমি নিলাম। আমি সিগারেট দিলাম, আপনি নিবেন।
শুভ্র বলল, বোয়াল মাছ আপনি খান। সিগারেট আমি খাই না। কাজেই নিব না।
হারুন বোয়াল মাছ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, সময় তিন দিন এক মিনিট। মনে থাকে যেন।
শুভ্ৰ জবাব দিল না। সে একদৃষ্টিতে ফ্যাতনার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন বলছে আরেকটা মাছ ধরা পড়বে। মাছের সংখ্যা হবে তিন। তিনি একটি প্রাইম সংখ্যা। পিথাগোরাসের মতে, অতি রহস্যময় সংখ্যা। স্বৰ্গ, মর্ত্য ও পাতালের প্রতীক। পৃথিবী, চন্দ্র এবং সূর্যের প্রতীক। তিন হচ্ছে। আমি, তুমি, সে। পিতা, মাতা ও সন্তান।
চরের লোকজন সবাই শুভ্ৰকে চিনে আধাপাগল মানুষ হিসাবে। আধাপাগলরা পথের ফকির হয়, ধলা মিয়া পথের ফকির না। সে অনেককেই ঘর বাঁধার বাঁশ কিনে দিয়েছে। চরে দুটা টিউবওয়েল বসিয়েছে। একটা স্কুলঘর তৈরি হচ্ছে। স্কুলঘরে চরের ছেলেমেয়েরা যাবে। পড়াশোনা করবে। তাদের জন্যে একজন শিক্ষকও জোগাড় হয়েছে। বাবু নলিনী বসাক। তিনি আগে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। নদীভাঙনের শিকার হয়ে ঢাকা শহরে বাচ্চাদের খেলনা এবং বেলুন বিক্রি করতেন। চরাঞ্চলে সবারই মূল নামের বাইরে আরেকটা নাম থাকে। বসাক স্যারের সেই নাম হচ্ছে পাইখানা স্যার! কোনো একটি বিচিত্র কারণে তিনি স্যানিটারি পায়খানা নিয়ে বিশেষভাবে উত্তেজিত। রিং এবং স্লাভ বসিয়ে কীভাবে স্যানিটারি পায়খানা তৈরি করতে হয় তা তিনি জানেন। এবং সবাইকে এই বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া পবিত্র দায়িত্ব মনে করেন। এইখানেই পাইখানা স্যার নামকরণের সার্থকতা।
চরের সবচেয়ে দুর্বল, অশক্ত এবং রুগ্ন মানুষটার নাম কল্লাকাটা। সে কথায় কথায় বলে, কোন বান্দিরপুত চর থাইকা আমারে সরাইব? কল্লা কইটা ফেলুম। কল্লাকাটার কাছে শুভ্ৰ দেবতাদের একজন। শুভ্র সম্পর্কে সামান্য বিরূপ কোনো কথা বললে সে চেঁচিয়ে বলে, ধলা মিয়া বিষয়ে একটা অন্ধমন্দ কথা কেউ বলছি কি কল্লা কাইটা ফেলুম।
চরে চার-পাঁচটা দোকান চালু হয়েছে। একটা চায়ের স্টল বসেছে এবং তারা ভালো ব্যবসা করছে।
শুভ্ৰ ঠেকে ঠেকে শিখছে। তার প্রধান শিক্ষা, কেউ কোনো স্বাৰ্থ ছাড়া কিছু করতে চায়-এই বিশ্বাস চরের মানুষদের নেই। শুভ্রর স্বাৰ্থ কী তারা বুঝতে পারছে না বলেই শুভ্রর বিষয়ে তাদের সন্দেহ দূর হচ্ছে না, বরং বাড়ছে।