আপনার সেই ব্যাংক একাউন্টের কাগজপত্র কার কাছে?
আমার কাছে না। ভাইয়ার কাছে।
আপনার নাম কী?
সায়মা হোসেন।
ডাকনাম? যুথী।
বাবার নাম?
আজহার আলি।
বড়ভাইয়ের নাম?
টুনি।
আপনার ব্যাংক একাউন্টে কত টাকা আছে আপনি জানেন?
কোনো টাকা থাকার কথা না। দুই হাজার টাকা দিয়ে একাউন্ট খোলা হয়েছিল, তারপর আর টাকা জমা দেওয়া হয় নি।
আপনার ব্যাংক একাউন্টে এই মুহুর্তে আছে এক কোটি সতেরো লক্ষ তিনহাজার দুশ টাকা।
যুথী চুপ করে রইল। তার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল।
ডিবি ইন্সপেক্টর বললেন, এটা ছাড়াও বনানীতে তিন হাজার স্কয়ার ফিটের একটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা আছে আপনার নামে।
আমি এইসব কিছুই জানি না। জানলে যে কষ্টের ভেতর দিয়ে সংসার চলছে তার থেকে মুক্তি চাইতাম। ব্যাংকের টাকা খরচ করতাম।
এই টাকা আপনার ভাই কীভাবে সংগ্ৰহ করেছেন তা জানেন?
জানি না, তবে অনুমান করতে পারছি। এবং ভাইয়া কেন কিছুদিন পরপর উধাও হয়ে যেত তাও বুঝতে পারছি। ভাইয়া কি আপনাদের হাতে ধরা পড়েছে?
সে ক্রসফায়ারে মারা গেছে।
যুথী বলল, আমি কি কিছুক্ষণ কাঁদতে পারি? না-কি আপনাদের এখানে কাঁদাও নিষেধ?
কাঁদতে পারেন।
যুথী শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ চেপে ধরে ফোঁপতে ফোঁপাতে বলল, আমি এতদিন জেনে এসেছি ভাইয়া এই পৃথিবীর শ্ৰেষ্ঠ কিছু মানুষের একজন।
ডিবি ইন্সপেক্টর যুথীর মুখের ওপরের লাইটটা সরিয়ে দিলেন।
আপনি কি আপনার ভাই সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু তথ্য দেবেন?
যুথী চোখ মুছতে মুছতে বলল, এখন তথ্য দিয়ে কী হবে?
ডিবি ইন্সপেক্টর বললেন, তথ্য সবসময় গুরুত্বপূর্ণ।
যুথী বলল, আমি তার সম্পর্কে যেসব তথ্য দেব তার কোনোটাই আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না।
তারপরেও শুনি।
ভাইয়া সুন্দর পেন্সিল স্কেচ করতে পারত। তাঁর আঁকা একটা পোর্ট্রেট আমাদের বসার ঘরে বাঁধানো আছে। এই তথ্য কি আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ?
না।
ভাইয়া একবার একটা গল্প লিখেছিল। গল্পটার নাম মাহিনের মৃত্যু। গল্পটা একটা দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতায় ছাপা হয়েছিল। আমার কাছে কপি আছে।
আর কিছু?
গল্পে সে নিজের নাম দেয় নি। ছদ্মনাম দিয়েছিল। ছদ্মনাম ছিল ভৃগু সেন। এই তথ্য নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সে নিজেকে আড়ালে রাখত। আমি এক কাপ আগুনগরম চা খেতে চাই। চা কি পাওয়া যাবে?
পাওয়া যাবে।
প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। মাথাব্যথার দুটা টেবলেট কি পেতে পারি?
অবশ্যই। মাথা ধরার টেবলেট আনিয়ে দিচ্ছি। আপনি ওষুধ এবং চা। খেয়ে বাসায় চলে যান। পুলিশের গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেবে।
আজহার মেয়েকে দেখে বললেন, ঘটনা কী বল। পুলিশ তোকে ধরে নিয়ে গেল কেন? বাড়ি সার্চ করল কেন?
যুথী বলল, কে যেন পুলিশকে খবর দিয়েছে আমি বিভিন্ন জায়গায় ড্রাগ সাপ্লাই করি। ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসি। এইজন্যেই ধরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছে।
আজহার বললেন, কে দিয়েছে এরকম একটা মিথ্যা খবর?
আমি কী করে জানব?
পুলিশকে জিজ্ঞেস করিস নাই?
না।
গাধি মেয়ে। তোর এটা জানা দরকার না? যা এক্ষুনি থানায় যা। জেনে আয়। তারপর দেখ আমি কী করি।
কী করবে?
মানহানির মামলা। দশ লাখ টাকার মানহানির মামলা। ঘাড়ে গামছা দিয়ে টাকা আদায় করব। মগের মুলুক পেয়েছে? This is not মগ’স মুল্লুক।
যুথী বলল, বাবা, চিৎকার কোরো না।
আজহার বললেন, এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে, তারপরেও আমি চিৎকার করব না? মুখে চুষনি দিয়ে বসে থাকব? You dont know your father.
যুথী অনেক সময় নিয়ে অবেলায় গোসল করল। নতুন একটা শাড়ি পরল। এই শাড়ি টুনু তাকে দিয়ে বলেছিল, বিরাট কোনো আনন্দের ঘটনা ঘটলে এই শাড়িটা। পরবি। আজ কি যুথির জীবনের খুব আনন্দের কোনো দিন? অবশ্যই না। তারপরেও এই শাড়িটা সে কেন পরল। নিজেও জানে না। মানুষের অনেক কর্মকাণ্ডই যুক্তিছাড়া।
পুলিশ যুথীর ঘরও লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। ঘর গোছাতে হবে। ইচ্ছা করছে না। এই মুহুর্তে মন চাইছে ভাইয়ের লেখা মাহিনের মৃত্যু গল্পটা পড়তে। গল্পটা খুঁজে বের করতে ইচ্ছা করছে না।
টুনুর লেখা গল্প
দৈনিক ভোরের কাগজের সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত টুনুর লেখা গল্প।
মূল উপন্যাসের সঙ্গে এই গল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা মূল উপন্যাসে থাকতে চান, তারা এই অধ্যায়টা বাদ দিতে পারেন।
মাহিনের মৃত্যু
তৃপ্ত সেন
রাত দশটা থেকে দশটা পীচ এই সময়ের মধ্যে মাহিনের মৃত্যু হবে। এই তথ্য সে জানত। তাকে সন্ধ্যা ছাঁটায় মোবাইল ফোনে জানানো হয়েছে। টেলিফোন পাওয়ার পর তার সামান্য শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। সে হাঁ করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে শুরু করল। মাহিনের স্ত্রী শেফালী বলল, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে?
মাহিন মুখে কিছু বলল না, হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
শেফালী বলল, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে?
হুঁ।
বেশি?
না বেশি না।
কতবার বলেছি। একজন ডাক্তার দেখাও। আমার কোনো কথা তুমি শোনো না। বুকে তেল মালিশ করে দিব?
না। ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খাব। খুব ঠান্ডা।
শেফালী বলল, ফ্রিজের মনে হয় গ্যাস চলে গেছে। ঠান্ডা হয় না। পাশের ফ্ল্যাট থেকে এনে দেই?
লাগবে না।
কেন লাগবে না! ঠান্ড পানি নিয়ে আসছি।
শেফালী পানির বোতল নিয়ে এসেছে। মাহিনের হাতে পানির গ্ৰাস। এমনিতেই পানি ঠান্ডা, তারপরেও গ্লাসে দুটা বরফের টুকরা ভাসছে। মাহিন বরফের টুকরা দুটার দিকে তাকিয়ে আছে।