মেরাজউদ্দিন বললেন, তাকে কোথায় পাওয়া গেছে বুঝিয়ে বলো।
সাদেক বলল, ময়মনসিংহে হালুয়াঘাটের কাছে। সোমেশ্বরী নদীতে একটা নৌকায় ছোট স্যার থাকেন।
রেহানা বললেন, ওই বদ মেয়েটাও কি শুভ্ৰর সঙ্গে নৌকায় থাকে?
জি-না। আম্মা। সে তার ফ্যামেলি নিয়ে আরেকটা নৌকায় থাকে। রান্নাবান্না ঐ নৌকাতেই হয়। তারা নৌকা কখনো এক জায়গায় রাখে না। তবে আমাদের চোখের আড়াল হবার কোনো উপায় নেই। আমাদের একটা ইঞ্জিন নৌকা সবসময় তাদের অনুসরণ করছে।
রেহানা বললেন, আমি এক্ষুনি হালুয়াঘাট রওনা হব।
মেরাজউদ্দিন বললেন, তুমি অবশ্যই রওনা হবে না। শুভ্র এসে এ বাড়িতে ঢুকবে। তার টাকাটা শেষ হলেই সে এই কাজটা করবে। তার বিষয়ে তো সব জানলে, এখন আর অস্থির হবার কিছু নেই।
মেরাজউদ্দিন খাম নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে গেলেন। খামে যুথীর বিষয়ে যা লেখা–
নাম : সায়মা হোসেন যুথী।
[যুথী নামে পরিচিত]
শিক্ষা : ম্যাথমেটিক্সে অনার্স পাশ করেছে। ফলাফল প্রথম শ্রেণী। M.Sc.- তে ভর্তির টাকা জমা দিলেও ক্লাস করে নি।
পেশা : চারটা টিউশনি করে। একটি মেয়ে, তিনটি ছেলে। (তাদের বাসার ঠিকানা আলাদা সংযুক্ত)
পরিবার : একটি মাত্র ভাই, নাম টুনু। বর্তমানে নিখোঁজ, আশঙ্কা করা হচ্ছে, র্যাবের হাতে ক্রসফায়ারে নিহত।
এই পর্যন্ত পড়েই তিনি সাদেককে আবারও ডাকলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, রিপোর্টে আশঙ্কা করা হচ্ছে, মনে হচ্ছে, ধারণা করা হচ্ছে জাতীয় কোনো বাক্য থাকা আমার পছন্দ না। যা লেখা হবে নিশ্চিত হয়ে লেখা হবে। টুনু ছেলেটি র্যাবের হাতে নিহত—এই তথ্য কতটুকু সত্যি?
পুরোটাই সত্যি।
ভুলে আশঙ্কা করা হচ্ছে লিখেছি।
সে কি সন্ত্রাসীদের কেউ? জি-না। অতি ভালো ছেলে। তবে ছোট-মজিদ তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা দুজন একই স্কুলে পড়ত। দুজন একই সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট ফেল করে। র্যাব তাকে দেখিয়েছে ছোট-মজিদের সহযোগী হিসেবে।
টুনুর পরিবারের কেউ বিষয়টা জানে না?
না। টুনুর ব্যাপারে তারা উদ্বিগ্নও না। সে প্রায়ই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে।
তুমি তার ব্যাপারে আরও তথ্য সংগ্ৰহ কোরো।
জি স্যার।
আমার ধারণা ছেলেটি সন্ত্রাসীদের একজন। অতি ভালো কোনো ছেলে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কারও সঙ্গে ঘুরবে না। ছেলেটি কি বিবাহিত?
জি।
তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ কোরো। তার স্ত্রীই স্বামী সম্পর্কে আসল কথাটি বলতে পারবে। একটি চীনা প্রবচন আছে, কোনো পুরুষমানুষের বিষয়ে যেসব তথ্য ঈশ্বর জানেন না, সেসব তথ্য তাদের স্ত্রীরা জানেন।
আজ নীপার পেট্রেট করা শুরু হবে। সে রাজি হয়েছে। সফিক রঙ-তুলি-ক্যানভাস নিয়ে এসেছে। ছবিটি সে করবে তেলরঙে। এতে ভুল হলে ত্রুটি শোধরাবার সুযোগ থাকবে।
সফিক বলল, বিষয়টা আমি যেভাবে দেখছি তা বলি। অলস দুপুর। ঠান্ডা মেঝেতে তুমি হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছ। তোমার কাছে এক গ্লাস পানি টলটল করছে। পানির গ্লাসের কাছে একটা গল্পের বই। এই বইটা কিছুক্ষণ আগে তুমি পড়ছিলে।
কী গল্পের বই?
ধরো শরৎচন্দ্রের দেবদাস।
নীপা বলল, কোনো মেয়ে নেংটা হয়ে শরৎচন্দ্রের দেবদাস পড়ে না।
তাহলে টনি মরিসনের একটা বই থাকুক।
নীপা বলল, না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য বইটা থাকুক।
আচ্ছা থাকুক।
শেষ করতে কতদিন লাগবে?
সাতদিন লাগবে। সাতদিন তোমার সামনে আমি নেংটো হয়ে শুয়ে থাকব?
হুঁ।
আমি একটা ভালো বুদ্ধি দেই?
দাও।
আমার ফিগারের সঙ্গে লাইলির ফিগারের মিল আছে। তুমি যখন মুখ আঁকবে তখন আমি থাকব। অন্যসময় লাইলি থাকবে।
সে কি রাজি হবে?
নীপা বলল, কেন রাজি হবে না? প্রথম সেশন লাইলিকে নিয়ে করো।
পোট্রেটের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। ক্যানভাসে ড্রয়িং করা হচ্ছে। সফিক বলল, লাইলি, তোমাকে অনেকবার দেখেছি। তুমি যে এতটা সুন্দর আগে বুঝি নি।
লাইলি স্বাভাবিক গলায় বলল, খোসা ছাড়ানোর আগে দেখেন নি, তাই বুঝেন নি।
সফিক বলল, অস্বস্তি লাগছে না তো?
না। ঘুম পাচ্ছে।
ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুমিয়ে পড়লেই আমার জন্যে সুবিধা। লাইলি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। খোলা জানালায় কিছু আলো এসে পড়েছে তার গায়ে এবং পানির গ্লাসে। পানির গ্লাস ঝলমল করছে। সফিক বলল, আমার এই ছবির টাইটেল হলো তৃষ্ণা। নাম ঠিক আছে না?
নীপা হাই তুলতে তুলতে বলল, ঠিক আছে।
সফিক বলল, লাইলির পায়ের পজিশন সামান্য চেঞ্জ করা দরকার।
নীপা বলল, চেঞ্জ করে দাও। চেঞ্জ করলেই ঘুম ভেঙে যাবে। আমি চাই ঘুমিয়ে থাকুক। ঘুমন্ত অবস্থায় মূল ড্রয়িংটা শেষ করে ফেলি।
সফিক বলল, রবীন্দ্রনাথের ওই গানটা কি তোমার কাছে আছে? চক্ষে আমার তৃষ্ণা। তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে। আমি বৃষ্টি বিহীন বৈশাখী দিন…
নীপা বলল, খুঁজে দেখি।
যুথীর গানের ক্লাস আজকের মতো শেষ। অশোক বাবু আগ্রহ নিয়ে নাশতা খাচ্ছেন। সুজির হালুয়া, পরোটা এবং সিদ্ধ ডিম। চা দেওয়া হয়েছে। পিরিচ দিয়ে চায়ের কপি ঢাকা।
অশোক বাবু ডিম মুখে দিতে দিতে বললেন, যতটুক উন্নতি আমি আশা করেছিলাম তারচেয়ে অনেক কম হয়েছে। হতাশাজনক পরিস্থিতি। সঙ্গীতে আপনার মন নাই।
যুথী বলল, কোনোকিছুতেই আমার মন নাই। খামাখা সপ্তাহে একদিন হারমোনিয়াম নিয়ে ভ্যা ভ্যা করি; আজই আমার শেষ ক্লাস। আর শিখব না।
এটা কেমন কথা!