আমিরুল বলল, আমি আরেক কাপ চা খাব।
যুথী বলল, একটু আগে বললেন, চা-টা ভালো হয় নি।
আমিরুল বলল, চা ভালো হয় নি, কিন্তু গল্পগুলি ভালো হচ্ছে। গল্প শোনার জন্যে আরেক কাপ চা খাব। এটা আমার ভিজিট।
মেরাজউদ্দিন এবং রেহানা পাশাপাশি বসে আছেন। তাদের সামনে আহসান। মেরাজউদ্দিনের ভঙ্গি শাস্ত। তার হাতে পাইপ। পাইপের আগুন নিভে গেছে, তারপরেও তিনি পাইপ হাতে রেখেছেন। মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরছেন। রেহানা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। তিনি কোনোদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতেও পারছেন না। তার চোখে জ্বালাপোড়া রোগ হয়েছে। চোখ সবসময় খড়খড় করছে। চোখের ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, অশ্রুগ্রন্থি থেকে ঠিকমতো অশ্রু বের হচ্ছে না বলে এই সমস্যা। চিকিৎসা হিসেবে অন্যের চোখের পানি ড্রপারে করে চোখে দিতে বলা হয়েছে। কৃত্রিম চোখের পানিও পাওয়া যায়, সেটা তেমন কাজ করে না। অনেককেই চোখের পানির কথা বলা হয়েছে। কেউ এখনো জোগাড় করে দিতে পারে নি। বাংলাদেশের মানুষ সারাক্ষণই না-কি কৰ্ম্মদে। অথচ প্রয়োজনের সময় চোখের পানি নাই।
আহসানের সামনে চায়ের কাপে চা দেওয়া হয়েছে। কেক দেওয়া হয়েছে। সে চায়ের কাপে চুমুক দেয় নি। বিঙ্কিট স্পর্শ করে নি। তার মনের অবস্থা চাবিঙ্কিট খাবার মতো না। তাকে মেরাজউদিনের প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। খুব ভেবেচিন্তে জবাব দিতে হচ্ছে।
যুথী মেয়েটা তোমার সঙ্গে কঠিন এবং রূঢ় আচরণ করেছে। এবং তার শেষ কথা ছিল Get lost.
জি স্যার।
মেরাজউদ্দিন বললেন, শুভ্ৰকে সে প্রতিবন্ধী হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং তার চিঠি সে পড়ে নি?
জি স্যার।
মেরাজউদ্দিন বললেন, এবং যুথী মেয়েটি বলেছে। কেউ যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় সে আমার কাছে আসবে। আমি কেন তার কাছে যাব?
জি স্যার।
এর বাইরে কিছু আছে?
এর বাইরে কিছু নাই স্যার।
মেরাজউদ্দিন বললেন, গাড়ির ড্রাইভার বলছিল তুমি গাড়িতে ফেরার সময় বিড়বিড় করছিলে—এত বড় সাহস। আমাকে কানে ধরতে বলে। যুথী কি বলেছিল কানে ধরতে?
আহসান হকচকিয়ে গিয়ে বলল, জ্বি স্যার।
এই কথাটা আমাকে বলে নি কেন?
বলতে লজ্জা লাগিছিল স্যার।
মেরাজউদ্দিন বললেন, লজ্জা লাগারই কথা। তুমি এমন কী ভুল করেছ যে বাচ্চা একটা মেয়ে তোমাকে কানো ধরতে বলছে? করেছ কোনো অন্যায়?
জি-না।
মেয়েটির সঙ্গে কি তোমার কোনো পূৰ্বপরিচয় ছিল? আগে কি কখনো তাকে দেখেছ?
জি-না।
চিঠি দিতে গিয়ে তার সঙ্গে তোমার প্রথম পরিচয়?
জি স্যার।
মেরাজউদ্দিন রেহানার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি এক কাপ চা খাব। চাটা তুমি নিজে বানাবে।
এই কথার অর্থ রেহানাকে এখন উঠে যেতে হবে। রেহানা উঠে গেলেন। মেরাজউদ্দিন হাত থেকে পাইপ নামিয়ে আহসানের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, অনেকগুলি বড় বড় প্রতিষ্ঠান আমি চালাই। তার জন্যে তোমার মতো চৌকষ অনেক অফিসার আমার আছে। তাদের কাজকর্ম পরিচালনার জন্যে আমার ছোট্ট একটা টিম আছে। এদেরকে তুমি গুপ্তচর বলতে পার। গুপ্তচরদের মধ্যে সিনিয়র অফিসার। যেমন আছেন আবার অতি সামান্য পিয়ন যার কাজ চা বানানো তারাও আছে। এরা প্ৰতিমাসে একটা রিপোর্ট দেয়। রিপোটে দেখলাম যুথী মেয়েটাকে তুমি চাকরি দিয়েছিলে। সে যেদিন চাকরিতে জয়েন করতে এল, তুমি তাকে জয়েন করতে দাও নি। কারণ কী?
আহসান বলল, পুরো ব্যাপারটা স্যার আমি ঝোঁকের মাথায় করেছি।
ঝোঁকটা তৈরি হলো কেন বলো? অনেক অর্ধসত্য বলেছি, আর অর্ধসত্য বলবে না।
স্যার, আমার খুবই পরিচিত একজন মানুষ আছেন, তাঁকে আমরা বলি করিম আংকেল। অত্যন্ত আমুদে মানুষ। উনি একটা ছবি বানাচ্ছেন, ছবির নাম গুহামানব। ছবিতে বস্তির একটি অল্পশিক্ষিত মেয়ে হঠাৎ বড় একটা চাকরি পেয়ে যায়। একমাস পর তার জয়েন করার কথা। এই একমাসে সে অনেক কিছু করে। ভালো একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। ভাইবোনদেরকে স্কুলে ভর্তি করে। চাকরিতে জয়েন করার দিন দেখে, তার চাকরি হয় নি। সে ফিরে যায় আগের জায়গায়। বাস্তবে ঘটনা কী ঘটে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন। তাঁর কথামতো আমি যুথীকে দিয়ে experimentটা করি।
করিম আংকেল মনে হচ্ছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ।
জ্বি স্যার।
তাঁকে আমার অফিসে আসতে বোলো। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলব।
জ্বি স্যার। মেরাজউদ্দিন হাতে পাইপ নিতে নিতে বললেন, তুমি যে অন্যায়গুলি করেছ। সেই অন্যায় আমি করলে আমি অবশ্যই মেয়েটির কথামতো কানো ধরতাম। যাই হোক, তোমার সঙ্গে কথা শেষ! তুমি এখন যেতে পারো। সাদেক বসে আছে, তাকে আমার কাছে পাঠাও।
মেরাজউদ্দিন সাহেবের কয়েকজন পার্সোনাল সেক্রেটারির ভেতর সাদেক একজন। সদেকের সব কর্মকাণ্ডই ধোঁয়াটে। সে একমাত্র কর্মচারী যার বেতন মেরাজউদ্দিন নিজে দেন।
মেরাজউদ্দিন বললেন, শুভ্রর কোনো খোঁজ বের করতে পেরেছ?
পারি নাই স্যার।
যুথীর বিষয়ে রিপোর্টটা তৈরি হয়েছে?
জ্বি স্যার।
সাদেক টেবিলের ওপর একটা খাম রাখল। মেরাজউদ্দিন খাম হাতে নিতে নিতে বললেন, শুভ্রর মা অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েছে। তার মানসিক শান্তির জন্যে তাকে কিছু মিথ্যা কথা বলা দরকার। তুমি বলবে শুভ্রর খোঁজ পাওয়া গেছে।
জি স্যার।
রেহানা চা নিয়ে ঢুকলেন। সাদেক বলল, আম্মা, ছোট স্যারের খোঁজ পাওয়া গেছে।
রেহানার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। গরম চা ছিটকে তাঁর পায়েও পড়ল। তিনি গরমটা বুঝতেই পারলেন না।