শুধু তোমার বাণী নয় গো
হে বন্ধু, হে প্ৰিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশাখানি দিয়ো।
সারা পথের ক্লান্তি আমার
সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মেটাব যে
খুঁজে না পাই দিশা।
এ আধার যে পূর্ণ তোমায়
সেই কথা বলিয়ো।
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশাখানি দিয়ো।
হৃদয় আমার চায় যে দিতে
কেবল নিতে নয়,
বয়ে বয়ে বেড়ায় সে তার
যা-কিছু সঞ্চয়।
হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো,
দাও গো আমার হাতে,
ধরব তারে, ভরব তারে
রাখব তারে সাথে
একলা পথে চলা আমার
করব রমণীয়!
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশাখানি দিয়ো।
আজহার তাঁর বড়ভাইকে ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। নানান ধরনের চিকিৎসা একসঙ্গে শুরু হয়েছে। বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ (গ্যারান্টি দিয়ে ক্যানসার এবং হাঁপানীর চিকিৎসা করেন। তিনবার স্বর্ণপদক প্রাপ্ত) এস নন্দি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করছেন। চব্বিশ ঘণ্টায় সাগুদানা সাইজের একটা বড়ি খেতে হয়।
ভেষজ চিকিৎসা চলছে। ওলট কম্বল গাছের পাতা ভেজানো পানি সকালে একগ্লাস করে খাচ্ছেন।
স্বপ্নযোগে পাওয়া বিকট দুর্গন্ধের সিরাপ খালিপেটে এক চামচ করে খাওয়া হচ্ছে। যে মহিলা এই সিরাপ দিয়েছেন তিনি বলেছেন, এই ওষুধের কাছে ক্যানসার সর্দিজ্বরের মতো মামুলি। সমস্যা একটাই, এই ওষুধ খেলে অন্য ওষুধ বন্ধ রাখতে হবে। ওষুধ যদি কাজ না করে এই একটা কারণেই করবে না।
রোগী এখন কোনো খাবারই খেতে পারছেন না। তবে তার নানাবিধ অদ্ভুত খাবার খেতে ইচ্ছা করছে। যেমন করলা দিয়ে টেংরা মাছের ঝোল। খইলাসা মাছের টক সালুন। ওলকচুর ভর্তা। চিতল মাছের ডিমের ভুনা।
আজহার ভাইয়ের খাবারের জন্যে প্রচুর ছোটাছুটি করছেন। রাতে তিনি হাসপাতালেই থাকেন। মাদুর এবং মশার কয়েল সঙ্গে নিয়ে যান। বারান্দায় মশার কয়েল জ্বালিয়ে মাদুর পেতে শুয়ে থাকেন। রাতে তার ঘুম একেবারেই হয় না। তিনি কয়েকবার ভাইয়ের বিছানার কাছে যান। হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকেন। চোখের সামনে মৃত্যুকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে তার শরীরে মাঝে মাঝে কঁপুনি আসে। ভাইয়ের সঙ্গে কিছু কথাবার্তাও মাঝে মাঝে হয়। সবই সাংসারিক কথা।
আজহার, আমার দুই পুলার কারবার দেখছস? বাপ মৃত্যুশয্যায়, আর দুইভাই আছে সংসার নিয়া। এই সময় পুলাপানের মুখ দেখলেও শরীরে কিছু বল হয়। হয় না?
আজহার চুপ করে থাকেন। খবর দেওয়ার পরেও দুই ছেলের কেউ আসে নি। এই ঘটনা সত্য।
এরা কী জন্যে আসে না জানস? আসলেই চিকিৎসা খরচ দিতে হবে। এই ভয়ে আসে না। এমনিতে দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো মিল নাই! একটা দিকে মিল। বাপের জন্যে কিছু করব না; তোর ভাগ্য ভালো, তোর পুলাপান এরকম হয় নাই। টুনু তো বাপ ভক্ত। তার কোনো খোঁজ আছে?
না।
নখপড়ার ব্যবস্থা কর। নখাপড়ার মাধ্যমে সব জানা যাবে।
আজহার বললেন, কোনো প্রয়োজন নাই। বাকি জীবন এই ছেলের আমি মুখ দর্শন করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাড়িতে যদি আসে। পাছায় লাখি দিয়ে রাস্তায় বের করে দিব।
এটা ঠিক না। নিজের সন্তানের দিকে মুহাব্বত না দেখালে আল্লাপাক নারাজ হন।
তিনি যে নিজের সন্তানদের প্রতি যথেষ্টই মুহাব্বত দেখিয়েছেন তা জানা গেল বুধবার রাতে। ওইদিন রাতে তিনি ইমাম সাহেবের কাছে তওবা করলেন এবং ভাইকে ডেকে বললেন, একটা অন্যায় করেছি, মাফ দিয়া দে।
আজহার বললেন, কী অন্যায় করেছেন?
তোর বিষয়সম্পত্তি জাল দলিল করে দুই ছেলের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দিয়েছি। এখন মামলা মোকদ্দমা করে এই দুইজনরে তুই ঝামেলা করিস না। বড়ভাই হিসাবে তোর কাছে এইটা আমার আবদার। আমার গায়ে হাত দিয়া তুই কথা দে।
আজহার বললেন, হুঁ।
হুঁ কী? বল কথা দিলাম।
আজহার বললেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে আপনাকে যে জমি কেনার জন্যে দিয়েছিলাম। সেই জমিরও কি এই অবস্থা?
হাজি মোবারক জবাব দিলেন না।
হাজি সাহেব যে মৃত্যুর প্রস্তুতি হিসেবে তওবা করলেন তা-না। রাত বারোটার পর থেকে শুরু হবে জিন চিকিৎসা। ইমাম সাহেবের পোষা জিন কোহিকাফ নগর থেকে তাঁর জন্যে ওষুধ নিয়ে আসবে। যে রোগীর এই চিকিৎসা হবে তাকে নিষ্পাপ হতে হবে। তওবার মাধ্যমে নিষ্পাপ হবার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো।
রাত বারোটায় জিনের আনা দুটা কিসমিস খেয়ে রোগী বললেন, শরীর এখন ভালো। জুলাযন্ত্রণা নাই বললেই হয়। নিঃশ্বাসের কষ্ট কমে গেছে।
রাত দুটায় তিনি মারা গেলেন।
বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে দুই ছেলে এসে উপস্থিত হলো। তারা খুবই হৈচৈ শুরু করল, কারণ বাবার ঠিকমতো চিকিৎসা হয় নাই! সেবাশুশ্রূষা হয় নাই। ইত্যাদি।
আজহার অফিসে যাচ্ছেন না
দুদিন হলো আজহার অফিসে যাচ্ছেন না। শোবার ঘরে ঝিম ধরে বসে আছেন। একটার পর একটা বিড়ি টানছেন। বিড়ির ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার। মাঝে মাঝে গলা খাকারি দিচ্ছেন। তখন গলা থেকে পশুর মতো অ্যাওয়াজ কেরা হচ্ছে।
তাঁর কোনো বড় সমস্যা যাচ্ছে। সমস্যার প্রধান লক্ষণ, তিনি খবরের কাগজ পড়ছেন না। কাগজ পড়া তার নেশার মতো। প্রথম একবার চা খেতে খেতে কাগজ শেষ করবেন। তারপর কাগজ নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাবেন। দ্বিতীয় দফায় বাথরুমে কাগজ পাঠ হবে। সেই কাগজ অতি যত্নে ভঁাজ করে তুলে রাখা হবে। অফিস থেকে ফেরার পর কাগজ আবার পাঠ করা হবে। এমন যার নেশা তিনি কাগজ পড়ছেন না। ঘরে বাজার নেই। তিনি বাজারে যাচ্ছেন না। গত দুদিন ডাল, ভাত আর ডিমের তরকারি দিয়ে খাবার তৈরি হচ্ছে। এই বিষয়েও তার কোনো বিকার দেখা যাচ্ছে না। খেতে ডাকলে যাচ্ছেন। সামান্য কিছু মুখে দিয়ে উঠে যাচ্ছেন। ভালো-মন্দ কিছু বলছেন না। খাবার টেবিলে বসে লবণ বেশি হয়েছে বা কম হয়েছে এই বিষয়ে তিনি কিছু বলবেন না তা হয় না।