সন্ধ্যাবেলা যুথীর বড় চাচা হাজি মোবারক এক টিন মুড়ি, এক টিন চিড়া এবং কলার কাদি নিয়ে উপস্থিত। তাঁর কিছুদিন ধরে পেটে ব্যথা। কোনো চিকিৎসাতেই আরাম হচ্ছে না। তিনি ঢাকায় বড় ডাক্তার দেখাতে এসেছেন।
বাড়িতে পা দিয়েই তিনি সবাইকে কলা খাওয়ানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আজহার বড়ভাইকে খুশি করার জন্যে পর পর চারটা কলা খেয়ে ফেললেন।
মোবারক বললেন, এই কলার নাম স্বর্ণচাঁপা কলা। এখনো ঠিকমতো পাকে নাই। পাকলে মধুর চেয়ে মিষ্ট হবে। তুই আরেকটা কলা খা।
আজহার পঞ্চম কলা খেলেন।
মোবারক বললেন, আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা। পেটে আলসার না। কী যেন রোগ আছে, ওইটা হয়েছে। মফস্বলের চিকিৎসায় কিছু উনিশ-বিশ হয় না। ঢাকার চিকিৎসা লাগবে।
আজহার বড়ভাইকে নিয়ে সেদিনই ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার নানান টেস্ট করতে দিয়ে বললেন, আমার সন্দেহ ক্টোমাক ক্যানসার। আমি সাজেষ্ট করব হাসপাতালে বা ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে যেতে। হাসপাতালে থেকে টেষ্ট করাতেও সুবিধা।
তৃতীয় দিনে ডাক্তার নিশ্চিতভাবে বললেন, ক্যানসার। তিনি আজহারকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে বললেন, ক্যানসারের শেষ পর্যায়। চিকিৎসায় ব্যথা কমবে, এর বেশি কিছু হবে না। ক্যানসার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। আপনারা এতদিন কোথায় ছিলেন?
আজহার বললেন, সুস্থ সবল মানুষ। হাঁটাচলা করছে। একা চলে এসেছে ঢাকায়। ঠিকমতো দেখেছেন?
ঠিকমতোই দেখেছি। অন্য কাউকে দেখাতে চাইলে দেখান।
আজহার ভাইকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। মোবারক বললেন, গাধা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিস। চেহারা দেখেই বুঝা যায় কিছু জানে না।
আজহার বললেন, কাল আরো বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। আপনি ঠিকই বলছেন। গাধা ডাক্তার।
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ডাক্তার একই কথা বললেন। মোবারক বললেন, ঢাকার সব ডাক্তারই তো মনে হয় গাধা। হয়েছে আলসার, বলে ক্যানসার। সব ডাক্তার আছে দুটা টাকা বেশি কামানোর ধােন্দায়। ক্যানসারের ভয় দেখিয়ে দুটা টাকা বেশি কামানো। আমি বাড়িতে চলে যাব। চিকিৎসা নাই খামাখা টাকা নষ্ট।
তিনি ঘুমান টুনুর ঘরে। সারা রাত ব্যথায় চিৎকার করেন। বাসার অন্য কেউ তাঁর গোঙানির শব্দে ঘুমাতে পারে না। হঠাৎ তার ব্যথা পুরোপুরি কমে যায়। তিনি উঠে বসে আনন্দিত গলায় ডাকেন, আজহার কই! আজহার!
আজহার ছুটে আসেন। মোবারক বললেন, ব্যথা একেবারেই নাই। আয় দুই চারটা সাংসারিক আলাপ করি। টুনুর কোনো সন্ধান কি পাওয়া গেল?
না।
আগে কখনো বাড়িঘর ছেড়ে গেছে?
আগেও গিয়েছে। পরীক্ষায় ফেল করলেই কিছুদিনের জন্যে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায়। দ্বিতীয়বার ইন্টারমিডিয়েটে ফেল করার পর তিন মাস বাসায় আসে নাই।
এইবার ঘরে ফিরা মাত্র বিয়ে দিয়ে দিবি। আমার হাতে পাত্রী আছে। মেয়ে শ্যামলা, তবে মুখের কাটিং ভালো। যুথী আম্মার চেয়েও ভালো। মেয়ের বাবার টাকা পয়সা আছে। মেয়ের জন্যে খরচপাতি করবে। আমি আভাস দিয়ে রেখেছি। তুই রাজি থাকলে ফাইনাল কথা বলব।
আজহার বিরসমুখে বললেন, আপনাকে কিছু বলতে হবে না। লোকমুখে শুনতে পাই হারামজাদা গোপনে বিয়ে করেছে।
মোবারক চিন্তিত গলায় বললেন, কী সৰ্ব্বনাশ! কই আমি তো কিছু জানি না। আপনাকে ইচ্ছা করে কিছু জানাই নাই। জানানোর মতো বিষয় তো না। টুনু কি ওই বউয়ের সঙ্গে আছে?
জানি না। মেয়েটাকে যে বিয়ে করেছে তার নাম কী?
জানি না।
লাইলিকে দেখে যে-কেউ বলবে নীপাদের বাড়িতেই সে বড় হয়েছে। এই বাড়ির বাইরে তার আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রথম দুদিন সে গেস্টরুমে ছিল, এখন সে নীপার সঙ্গে ঘুমায়।
নীপার বাবা আবদুর রহমান এর মধ্যে তিন দিনের জন্যে এসেছিলেন। নীপা লাইলিকে বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
বাবা, অনেকের পালক ছেলে পালক মেয়ে থাকে। এ আমার পালক বান্ধবী। এর নাম লাইলি। তবে আমি সংক্ষেপে ডাকি লা।
আবদুর রহমান হাসিমুখে বললেন, হ্যালো লা।
লাইলি কী বলবে বুঝতে পারল না। আবদুর রহমান বললেন, বিশাল বাড়িতে আমার মেয়ে একা থাকে। তার যে একটা সঙ্গী হয়েছে এতেই আমি খুশি। শুধু খুশি না, very happy.
আবদুর রহমান তিন দিনের জন্যে এসেছিলেন, এই তিন দিনের দুদিন ঘুমিয়ে কাটালেন। তৃতীয় দিনে ঘণ্টা চারেকের জন্যে বাইরে গেলেন এবং খুবই অল্পবয়স্ক এক তরুণীকে নিয়ে ফিরলেন। সুইমিংপুলে পানি দেওয়া হলো। দুপুরবেলা তরুণীকে নিয়ে তিনি সুইমিংপুলে নামলেন। নীপা এবং লাইলিকে খবর পাঠালেন তারাও যেন আসে।
লাইলি নীপকে বলল, ওই মেয়েটা কে?
নীপা বলল, জানি না। প্রথম দেখছি। বাবার কোনো বান্ধবী হবে। আগে কখনো দেখি নি। চলো সুইমিং করি।
লাইলি বলল, আমি না।
নীপা বলল, আমি না। আবার কী! চলো তো। সুইমিং করার সময় বাবা প্রচুর বিয়ার খায়। মজার মজার কথা বলে। শুনলে মজা পাবে।
লাইলি বলল, না।
নীপা বলল, দুবার না বলে ফেলেছ। তৃতীয়বার বললে কিন্তু চড় খাবে।
লাইলি পানিতে নেমেছে। তার গায়ে নীপার সুইমিং কস্টিউম; লজ্জায় সে নিজের দিকে তাকাতে পারছে না। অন্যদের দিকেও তাকাতে পারছে না। আবদুর রহমান বললেন, এই যে দুই বান্ধবী! পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, এই অতি রূপবতী মেয়েটির নাম অনিক। সে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করে। অনিকা, শুরু করো।
অনিকা সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি শুরু করল। তবে ইংরেজি কিছু না, বাংলা। সে এত সুন্দর করে আবৃত্তি করল যে শুনে লাইলির চোখে পানি এসে গেল। এ বাড়িতে ওঠার পর সে টুনুর কথা ভুলেই গিয়েছিল। টুনুর কথা মনে পড়ল।