আমার খুব ইচ্ছা অসংখ্য মানুষের জন্যে আমি সিঁড়ি কাটব। তখন আপনি আর আমাকে গাধামানব বলবেন না। বলবেন সিঁড়ি-মানব।
ইতি
শুভ্র
রেহান চিঠিটা স্বামীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোমার ছেলে রাজমিস্ত্রি হয়েছে। সিঁড়ি বানাবার কারিগর। চিঠিটা পড়ো।
মেরাজউদ্দিন চিঠি পড়লেন। আহসানকে বললেন, মেয়েটিকে তুমি আমার এখানে নিয়ে আসবে। মেয়েটির সাহায্য আমাদের প্রয়োজন। শুভ্ৰ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করলেও এই মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
স্যার, আমি এখনই যাচ্ছি।
মেরাজউদ্দিন বললেন, তোমাকে এখনই যেতে হবে না। তুমি আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় চেয়েছ। আটচল্লিশ ঘণ্টা পারু হোক। তারপর যাবে। আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর শুভ্রর সন্ধান পাওয়া মেয়েটির আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। বুঝতে পারছি?
পারছি। স্যার, আমি কি উঠাব?
হ্যাঁ।
আহসান চলে যাবার পর মেরাজউদ্দিন বললেন, রেহানা! চা খাব। চা দিতে বলো।
মেরাজউদিনের অসময়ে চা খাওয়ার অর্থ তিনি কোনো আলোচনায় যাবেন। চা তার পছন্দের পানীয় না। আলোচনার অনুষঙ্গ।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মেরাজউদ্দিন বললেন, একটা বয়সে প্রতিটি যুবক কিছুদিনের জন্যে কার্ল মার্কস্ হয়ে যায়। নিপীড়িত অবহেলিত মানুষের জন্যে কিছু করতে হবে-এই ভূত মাথায় ভর করে। এটা হলো এক ধরনের ভাইরাস সংক্রমণ। ভাইরাসের কোনো ওষুধ নেই। এই অসুখেরও ওষুধ নেই। কিছুদিন পর আপনাআপনি ভাইরাস মারা যায়। রোগী সেরে ওঠে। তোমার ছেলের ক্যাপারেও একই ঘটনা ঘটবে।
রেহানা বললেন, আমার ছেলে অন্য দশটা ছেলের মতো না।
মেরাজউদ্দিন বললেন, সব মায়ের ধারণা তার ছেলে অন্য দশজনের মতো না।
রেহানা বললেন, রবীন্দ্রনাথের মায়েরও নিশ্চয়ই এরকম ধারণা ছিল। রবীন্দ্ৰনাথ কি আলাদা না?
মেরাজউদ্দিন বললেন, তোমার ছেলে রবীন্দ্রনাথ না। আইনস্টাইনও না। সে পরীক্ষায় ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া একজন গৰ্ধব।
গৰ্ধব?
অবশ্যই। আমি চাই তার শিক্ষা সফর হোক। শিক্ষা সফর শেষে এই বাড়িতে সে ঢুকবে। তবে হেঁটে ঢুকবে না। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকবে।
এত রেগে গেছ কেন?
তোমার ছেলে একজন প্রস্টিটিউটের সঙ্গে বোন পাতাবো। পাইপে বাস করবে। আমি রাগ করব না? অফিস থেকে সে দুলক্ষ টাকা নিয়েছে। এক অর্থে চুরি করেছে। সে শুধু যে গর্ধব তা-না, চোর গর্ধব।
রেহানা বললেন, ওই টাকা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মেরাজউদ্দিন বললেন, গুড। পাঠিয়ে দাও।
এখন যুথীদের বাড়ির পরিস্থিতি বর্ণনা করা যেতে পারে।
টুনুর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। সে কোনোরকম যোগাযোগ করে নি। লাইলি এখনো নীপাদের বাড়িতে আছে। যুথীদের কারও সঙ্গে তার এখনো দেখা হয় নি বা টেলিফোনে কথা হয় নি। নীপা কয়েকবার টেলিফোন করেছে। যুথী টেলিফোন ধরে নি। টেলিফোন ধরার মতো অবস্থা তার ছিল না। জ্বরে এই কদিন অচেতনের মতো ছিল।
আজ তার জ্বর নেই। সে শুকনা মুখে বসার ঘরে বসে আছে। তার সামনে গানের টিচার অশোক মিত্র বসে আছেন। তিনি তবলা নিয়ে এসেছেন। ঝালর দেওয়া ওয়ার দিয়ে তবলা এবং বাঁয়া দুটাই ঢাকা। এই দুই বস্তু তাঁর অতি আদরের তা বোঝা যাচ্ছে।
অশোক মিত্র বললেন, আসুন শুরু করে দেই। হারমোনিয়াম কোথায়? কী হারমোনিয়াম, টিউনিং ঠিক আছে কি না দেখা দরকার।
যুথী বলল, কিছু মনে করবেন না, আমি গান শিখব না।
অশোক মিত্র বললেন, এটা কেমন কথা! আমার হিসাবের টিউশনি। আপনার জন্যে যে জায়গা রেখেছিলাম সেটা এখন কী করব? নতুন ছাত্র কই পাব?
যুথী বলল, আমার বিরাট বড় একটা আর্থিক সমস্যা হয়েছে। মাসে মাসে এক হাজার টাকা দেওয়া এখন আমার পক্ষে সম্ভব না।
যখন সম্ভব হবে তখন দিবেন। আপাতত আসা-যাওয়ার রিকশা ভাড়া আর যৎসামান্য নাস্তা দিলেই হবে। বাসে করেই আসা-যাওয়া করতাম। তবলা নিয়ে তো বাসে ওঠা সম্ভব না। হারমোনিয়াম নিয়ে পাশে বসেন।
যুথী বলল, আমার গলায় কোনো সুর নেই।
অশোক মিত্র বললেন, সুর আমি দিব। তিন বছর আমার সঙ্গে শিখবেন। তারপর বিটিভিতে অডিশন। এখন বিটিভিতে গানের অডিশন যে নেয় সে আমার ছাত্র। নাম রকিব। অডিশনে যেন পাশ করিয়ে দেয়। সেই দায়িত্ব আমার। ইদানীং শুনেছি সে অডিশনে পাশ করানোর জন্যে পার ক্যান্ডিডেট দশ হাজার করে টাকা নেয়। দেনদরবার করে সেটা হাফ করে দেব। আমি তার শুরু। গুরুর কথা সে ফেলতে পারবে না। কী হরমোনিয়াম কেনা হয়েছে একটু দেখি। খাতা লাগবে। খাতায় সরগম লিখে দিব। প্রথম দিন সারেগা এই তিনটা স্বরু। এর বেশি না। আমার শিক্ষাপদ্ধতি ভিন্ন।
যুথী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হরমোনিয়াম আনতে গেল।
ছুটির দিন। আজহার ঘুমাচ্ছিলেন। হারমোনিয়ামের শব্দে তাঁর ঘুম ভাঙল। তিনি বিছানায় উঠে বসে রাগী গলায় ডাকলেন, সালমা! সালমা!
সালমা ভীত মুখে উপস্থিত হলেন। আজহার বললেন, পেঁ পুঁ শব্দ কিসের?
সালমা বললেন, যুথীর গানের টিচার এসেছে।
আজহার বললেন, যুথীর গানের টিচার এসেছে মানে কী?
সে গান শিখবে বলে ঠিক করেছে।
আজহার বিস্মিত গলায় বললেন, সংসারের এই হাল। তার বড়ভাই নিখোঁজ। হারামজাদা গোপনে বিয়ে করেছে। সেই বৌ পড়ে আছে আরেক বাড়িতে। আর সে গান ধরেছে? নাচটা বাকি কেন? নাচ শিখুক। তারপর কোনো যাত্ৰাদলে ভর্তি হয়ে যাক। মেয়েকে ডাকো।
রেগাসা।
রেগাসা।
রেগা সাসারে।
রেগা সাসারে।
অশোক মিত্র বললেন, আপনার গান হবে এবং খুবই ভালো হবে। আপনার গলার স্বরে অস্বাভাবিক মিষ্টতা আছে। এই ধরনের কণ্ঠস্বরের একটা নাম আছে–কিন্নর স্বর। কিন্নর হলো দেবগায়ক। এখন আমার জন্যে একটু টিফিনের ব্যবস্থা করেন। ঘরে যদি ডিম থাকে একটা ডিম হাফবয়েল করে দিতে বলেন। আলাদা করে লবণ আর গোলমরিচ গুঁড়া। আর চিনি ছাড়া এককাপ দুধ-চা। আমার ডায়াবেটিস। ট্যাবলেট সঙ্গে আছে।