মা,
কাল রাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্নটা বেশ মজার। আমি চশমা হারিয়ে ফেলেছি। আর তুমি বলছি, কান্না বন্ধ করো। একটা স্পেয়ার চশমা সবসময় তোমার ড্রয়ারে থাকে। তুমি কি ড্রয়ার খুলে দেখেছ?
আমি ড্রয়ার খুললাম। দেখি ড্রয়ারে শুধু আমার মানিব্যাগটা আছে। আমি মানিব্যাগ খুলে দেখি মানিব্যাগের ভেতর আমার চশমা।
স্বপ্নে অনেক অদ্ভুত ব্যাপার হয় মা। মানিব্যাগের ভেতর টাকার বদলে চশমা পাওয়া যায়। তবে স্বপ্ন যত অদ্ভুতই হোক তার ব্যাখ্যা থাকে। চশমা ছাড়া আমি আচল, কাজেই যে-কোনো দুঃস্বপ্নে আমি চশমা দেখব। এটাই স্বাভাবিক।
টাকা পয়সার হঠাৎ অভাবে ঝামেলায় পড়েছিলাম বলে মানিব্যাগ স্বপ্নে দেখেছি।
মা শোনো। আমি চিকেন ফেদার অফিসের ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে দুলক্ষ টাকা স্লিপ কেটে নিয়েছি। বাবা ঘটনাটা জানলে হয়তো মনে কষ্ট পাবেন। বাবা আমার আইডল। আমি কোনো অবস্থাতেই বাবাকে কষ্ট দিতে চাই না। মা, তুমি তোমার কাছ থেকে দুলক্ষ টাকা অফিসে জমা দিয়ে দিয়ে। আমি ভালো আছি। বেশ ভালো আছি। তুমি এবং বাবা তোমাদের দুজনের ধারণা আমি তোমাদের প্রটেকশন ছাড়া অচল। ধারণা মিথ্যা।
মা শোনো। ঐদিন একটা অসহায় মেয়েকে তুমি সাহায্য করো নি। আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি জেনে এসেছি, তুমি এবং বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। এর ব্যতিক্রম যখনই দেখি তখন অস্থির লাগে।
মা, তুমি ভালো থেকে এবং আমার ওপর রাগ করো না। কেউ আমার ওপর রাগ করে থাকলে আমার কেমন জানি লাগে। নিজেকে তখন ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ মনে হয়।
ইতি
শুভ্র
মেরাজউদ্দিন বললেন, রেহানা, তুমি upset হয়ে না। সবকিছু কনট্রোলের ভেতর চলে আসবে। আমাদের হিসেবে সামান্য ভুল হয়েছে। ভুল হবেই। ভুল থেকে আমরা শিখব। আহসান কি এসেছে?
হ্যাঁ, ড্রয়িং রুমে বসে আছে।
ওকে ডাকো। ওর সামনে এমন কিছু করবে না যাতে অস্থিরতা প্রকাশ পায়। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি অস্থির হলে সেই অস্থিরতা সৈন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
রেহানা বললেন, আমরা কি যুদ্ধে নেমেছি?
প্রচুর বিত্ত মানেই যুদ্ধ। বিত্ত সামলানোর যুদ্ধ। বিত্ত বাড়ানোর যুদ্ধ।
মেরাজউদ্দিন এবং রেহানা খাবার টেবিলে বসে ছিলেন। আহসানকে ভীত এবং সংকুচিত ভঙ্গিতে তাদের সঙ্গে বসতে হলো। মেরাজউদ্দিন বললেন, আহসান, কেমন আছ?
আহসান বলল, স্যার ভালো আছি।
আজ আমার বাড়িতে কেক কাটার মতো একটা আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে। এই বিষয়ে কি কিছু জানো?
জানি না স্যার।
শুভ্রর M.Sc. পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। ও রেকর্ড নাম্বার পেয়ে প্রথমশ্রেণীতে প্রথম হয়েছে। সে যে KNS তা জানো?
জানি না। স্যার। KNS কী?
কালিনারায়ণ স্কলার। যাই হোক, চিকেন ফেদার অফিসে এই উপলক্ষে তোমরা একটা কেক কাটবো।
অবশ্যই স্যার।
মেরাজউদ্দিন আহসানের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, এডোলোসেন্স পিরিয়ড ১৯ বছরেই শেষ হবার কথা। অনেকের হয় না। শুভ্রর হয় নি। হয় নি বলেই সে পাইপের ভেতর বাস করার অদ্ভুত কাণ্ড করছে। তার বিষয় হচ্ছে Physics, পাইপ না।
অবশ্যই স্যার।
সে কোথায় থাকে কী ব্যাপার খোঁজ নিয়েছ?
নিয়েছি স্যার। তারা কেউ এখন সেখানে নেই। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারছে না।
রেহানা বললেন, যে মেয়েটিকে সে বোন বলছে, মর্জিনা না কী যেন নাম, ওই মেয়েটি কে?
আহসান বিব্রত গলায় বলল, বলতে লজ্জা পাচ্ছি ম্যাডাম। মেয়েটা একটা প্রস্টিটিউট।
কী বললে?
ম্যাডাম, ভাসমান পতিতা।
রেহানা এবং মেরাজউদ্দিন দুজনের কেউ বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না। দুজন অবাক হয়ে আহসানের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আহসান বলল, স্যার, আমাকে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিন, আমি খোঁজ বের করে ফেলব। সব জায়গায় খবর চলে গেছে। থানাতে জানিয়েছি। থানাওয়ালরা কিছু করতে পারবে না; আমি দালাল লাগিয়েছি।
মেরাজউদ্দিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে রেহানার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছেলে পুরো বিষয়টাকে যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং করে তুলেছে। তাই না?
রেহানা কিছু বললেন না। আহসান বলল, ম্যাডাম, আমার ওপর আর কোনো নির্দেশ কি আছে?
রেহানা বললেন, তুমি বলেছ শুভ্র আরেকটি মেয়েকে চিঠি লিখে গেছে। ওই চিঠি কি পৌঁছানো হয়েছে?
না। চিঠিটা আমার সঙ্গেই আছে। আপনি কি পড়ে দেখবেন?
রেহানা বললেন, দেখব।
মেরাজউদ্দিন বললেন, অবশ্যই তুমি সেই চিঠি পড়বে না। প্রাইভেসি আমাদের সবাইকে রক্ষা করতে হবে।
রেহানা বললেন, একটা সময় আসে যখন প্রয়োজনেই প্রাইভেসি ভাঙতে হয়। এখন সেই সময়। চিঠিটা আমি অবশ্যই পড়ব।
আহসান চিঠি এগিয়ে দিল।
যুথী,
আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন? সন্ধ্যাবেলা বাসায় চা খাবার দাওয়াত দিয়েছিলেন। আমি আসি নি। কেন আসতে পারি নি। সেই ব্যাখ্যাও করি নি।
এখন নিশ্চয়ই ব্যাখ্যাটা আপনি জানেন। আপনার বান্ধবী নীপা আপনাকে বলেছে। লাইলি কি ফিরেছে আপনাদের বাসায়?
No man is an island. আমরা কেউ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ না। আমরা খুবই ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। যে কারণেই লাইলি আপনাদের কাছে ফিরেছে কি না জানার জন্যে আমি আগ্ৰহী।
আপনি কি গান শেখা শুরু করেছেন? আমি নিশ্চিত, একদিন গায়িকা হিসেবে আপনার খুব নাম হবে। পত্রিকায় ইন্টারভিউ, অটোগ্রাফ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। সেইসব ইন্টারভিউতে আমার নাম চলে আসবে। আপনি বলবেন, আমার গানের সিঁড়ির প্রথম ধাপ শুভ্ৰ নামের একজন প্রতিবন্ধী মানুষ করে দিয়েছিলেন। আমাদের সবারই প্রথম কয়েকটি সিড়ি অন্যদের কেটে দিতে হয়। বাবা-মা-বন্ধুরা কাটেন। আবার নিতান্ত অপরিচিতজনও কাটেন। যেমন, আপনার একটি সিঁড়ি হলেও আমি কেটেছি।