শুভ্র বলল, পাইপের বাসা ব্যাপারটা কী?
গেলেই দেখবেন। বড় বড় পাইপের ভিতর সংসার।
মর্জিনার বাবা ইয়াকুব সত্যি সত্যি খাসির মাংস এবং পোলাও রান্না করেছে। মর্জিনা শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইজান, আমার কথা সত্য হইছে?
শুভ্ৰ বলল, হয়েছে। মর্জিনা বলল, আরাম কইরা খান। খায়া পাইপের ভিতর ঘুম দেন। ঝুম বৃষ্টি নামব। দেহেন আসমানের অবস্থা।
খেতে খেতে শুভ্ৰ ইয়াকুবকে বলল, আপনার রান্না অসাধারণ। খাসির মাংসের এই স্বাদ অনেকদিন আমার মুখে লেগে থাকবে। আপনি একটা রেস্টুরেন্ট দেন না কেন?
ইয়াকুব বলল, বাবা, টাকা থাকলে রেস্টুরেন্ট দিতাম। মূল জিনিসই নাই। মূল ছাড়া বিদ্যা কাজে লাগে না। তবে বাবা, একসময় আমার টাকা ছিল। পদ্মার ধারে টিনের ঘর ছিল। দুইটা গাভি ছিল। নৌকা ছিল। ধানী জমি ছিল কুড়ি বিঘা। বসতবাড়িতে আমগাছ ছিল এগারোটা, কাঁঠাল গাছ দশটা, গাব গাছ ছিল তিনটা। জাম্বুরা গাছ নয়টা…
মর্জিনা বলল, বাপজান, গাছের হিসাব বন্ধ করো।
ইয়াকুব বলল, গাছের হিসাব দিতে ভালো লাগে। মনে হয় এখনো সব আছে।
শুভ্র বলল, আপনার ঘরবাড়ি কোথায় গেছে?
পদ্মায় ভাইঙা নিয়া গেছে। তবে এখন খবর পাইছি বিরাট চর জাগছে। যাদের ঘর ভাঙছে, সরকার তারারে চরে জমি দিতেছে। ইচ্ছা করে একবার চেষ্টা নেই। আগের জমির দলিল সবই আমার কাছে আছে।
শুভ্র বলল, চেষ্টা নিতে সমস্যা কী?
মর্জিনা বলল, একটাই সমস্যা। আমরা গরিব। চরের দখল কোনোদিন গরিবে পায় না। এই আলোচনা বাদ। ভাইজান, পান খাইবেন?
শুভ্র বলল, পান আমি খাই না, কিন্তু আজ খাব।
হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। পান মুখে দিয়ে শুভ্ৰ পাইপের বিছানায় ঘুমুতে গেল। মর্জিনা মাথার কাছে কুপি এবং ম্যাচ রেখে বলল, ভাই পাতাইলে ভাইরে কিছু দিতে হয়। ধরেন ভাইজান, বিশটা টাকা রাখেন।
শুভ্র বলল, থ্যাংক য়্যু।
সে আগ্রহ করে টাকাটা নিল। পাইপের বিছানায় রাতে তার খুব ভালো ঘুম হলো।
চিকেন ফেদার-এর হেড অফিস
সকাল এগারোটা। চিকেন ফেদার-এর হেড অফিসে হঠাৎ করেই তুমুল ব্যস্ততা। এমডি সাহেব এসেছেন। তাঁর ঘরের তালা খুলে দেওয়া হয়েছে! ইলেকট্রিসিটি নেই বলে এসি চালু করা যাচ্ছে না। জরুরি ভিত্তিতে জেনারেটার দিয়ে এমডি সাহেবের এসি চালু করা হয়েছে।
চিকেন ফেদারের জেনারেল ম্যানেজার আহসান টেবিলের স্মাওনে দাঁড়িয়ে আছেন। এমডি সাহেবের অনুমতি ছাড়াই তিনি বসবেন কি বসবেন না। এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তাকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে।
শুভ্ৰ বলল, বসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
আহসান বসলেন।
শুভ্র বলল, মনে হয় আজ সন্ধ্যায় বাবার জাপান থেকে ফেরার কথা।
আহসান বিস্মিত হয়ে বললেন, উনি তো গতকাল ফিরেছেন! স্যার আপনি জানেন না?
শুভ্ৰ বলল, আমি বাড়িতে ছিলাম না। আমার এক বোনের সঙ্গে ছিলাম। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। যাই হোক, আমার কিছু টাকা দরকার। কীভাবে পাব?
টাকার পরিমাণ কত স্যার?
দুলাখ হলেই চলবে।
আহসান বললেন, একটা ক্লিপ দিয়ে ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে নিয়ে নিতে পারেন। কিংবা চেক কাটতে পারেন। আপনার ড্রয়ারে চেক বই আছে। চেক কাটলে একটু সময় লাগবে।
শুভ্ৰ স্লিপ লিখে টাকা নিল।
আহসান বললেন, চা খাবেন স্যার?
শুভ্ৰ বলল, চা খাব। চা দিতে বলুন। আমি দুটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। একটা যাবে আমার মার কাছে। আরেকটা যাবে একটা মেয়ের কাছে। তার ঠিকানা জানি না, তবে বাসা চিনি। আমার গাড়ির ড্রাইভার তার বাসা চেনে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।
আহসান বলল, অবশ্যই নিয়ে যাব। স্যার, আপনার বোনের বাসা কোথায়?
ও বস্তিতে থাকে। ঠিক বস্তিও বলা যাবে না। পাইপের ভেতর সংসার। জায়গাটা কটাবনের আশেপাশে। রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের গুদামঘরের বাউন্ডারির ভেতর।
আহসান বলল, স্যার, আমি খুবই কনফিউজড বোধ করছি।
শুভ্র বলল, কনফিউজড় হবার কিছু নেই। অনেকেই এ ধরনের বাড়িতে থাকে। ফুটপাতে থাকার চেয়ে ভালো।
স্যার, আপনি কি বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন? আমি লাইন করে দেব?
শুভ্র বলল, বাবার সঙ্গে এখন কথা বলব না। চা খেয়ে বিদায় হব।
কোথায় যাবেন?
কিছু বইপত্র কিনব।
স্যার, বইয়ের লিষ্ট দিয়ে দিন, আমি কিনে নিয়ে আসছি।
আমি নিজে দেখেশুনে কিনব।
আহসান বিব্রত গলায় বলল, স্যার, আপনার বোনের নামটা কি জানতে পারি?
শুভ্র বলল, অবশ্যই পারেন। ওর আসল নাম মর্জিনা। তবে ওকে সবাই ফুলকুমারী নামে চেনে। ওর বাবার নাম ইসহাক। আগে রিকশা চালাতেন। ট্রাকের ধাক্কায় পা কাটা পড়েছে। এখন পাইপেই বেশির ভাগ সময় থাকেন। উনার রান্নার হাত খুবই ভালো।
আহসান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে এক্ষুনি তার বড় সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। সেটাও করা সম্ভব হচ্ছে না। এমডি সাহেব সামনে বসে আছেন।
শুভ্ৰ চা খেয়ে টাকা নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
আহসান বলল, স্যার, আমি কি আপনার সঙ্গে আসব?
শুভ্ৰ বলল, না।
আপনি তো গাড়ি আনেন নি। অফিসের গাড়ি দিয়ে দেই?
শুভ্র বলল, না। রিকশায় করে ঘুরতে আমার চমৎকার লাগে।
শুভ্রর লেখা চিঠিটা রেহানা এই নিয়ে চারবার পড়লেন। পঞ্চমবার পড়তে যাচ্ছেন তখন মেরাজউদ্দিন বললেন, দেখি কী লিখেছে। রেহানা স্বামীর হাতে চিঠি দিয়ে চোখ মুছলেন। শুভ্র চলে যাবার পর থেকে একটু পর পর তাঁর চোখে পানি আসছে।
শুভ্র লিখেছে—