লাইলি দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করেছে। নীপার দেওয়া নাইটি পরেছে। পোশাকটা অশ্লীল ধরনের। লাইলির লজ্জা লাগছে, আবার ভালোও লাগছে।
নীপা বলল, এসো ছবি দেখি। বাড়িতে হোম থিয়েটার আছে। হোম থিয়েটারে ছবি দেখতে অন্যরকম মজা। বাবা যখন বাড়িতে থাকেন, তখন আমরা দুজনে মিলে হোম থিয়েটারে ছবি দেখি।
লাইলি বলল, হোম থিয়েটার কী?
হোম থিয়েটার হলো মিনি সিনেমাহল। Sixty two inches, টিভিতে ছবি দেখা। চারদিকে সাউন্ড বক্স দেওয়া। বসার সিটিগুলিও সিনেমা হলের সিটের মতো। একসঙ্গে বিশজন মিলে সিনেমা দেখার ব্যবস্থা। ভয়ের ছবি দেখবে?
দেখক।
সাইনিং ছবিটা দেখেছ? স্ট্যানলি কুব্রিকের?
চমৎকার ছবি। আমি একবার দেখেছি। আরেকবার দেখতে কোনো সমস্যা নাই।
আপনার বাবা কোথায় থাকেন?
উনি জাহাজে জাহাজে থাকেন। আর আমার মা বাবার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছেন। আমি উনাকে ডাকতাম মজুচাচা। খুব মজা করতেন, এইজন্যে মজুচাচা। মা এখন মজুচাচার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন। মায়ের একটা ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম মা আমাকে রাখতে বলেছিলেন। আমি রেখেছি। তার নাম দিয়েছি বন্ধু! নামটা সুন্দর না?
লাইলি তাকিয়ে আছে। নীপা নামের মেয়েটা কত সহজেই না নিজের কথা বলে যাচ্ছে। সে কি কোনোদিন এভাবে কথা বলতে পারবে? বিশাল যারা বড়লোক তারা মনে হয়। এভাবেই কথা বলে। আর যারা তার মামার মতো অভাবী মানুষ, তাদের কথাগুলিও হয় অভাবী।
শুভ্ৰ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে আছে। জায়গাটা অন্ধকার না। স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো আছে। বসে থাকতে শুভ্ৰয় খারাপ লাগছে না। কিছুক্ষণ আগে একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। শুভ্রর শার্ট ভিজেছে। বাতাসে ভেজা শার্ট থেকে ঠান্ডা গায়ে লাগছে। গা কেঁপে উঠছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে অতিরিক্ত ঠান্ডা কোনো এসি ঘরে বসে আছে। তার বাবার অনেকগুলি অফিসের একটা এরকম ঠান্ডা। চিকেন ফেদার কোম্পানির এমডির অফিস।
চিকেন ফেদার নামটাও শুভ্রর দেওয়া। এবং কাগজেকলমে শুভ্ৰ সেই অফিসের এমডি; যদিও মাত্র দুবার সেই অফিসে গিয়েছে।
শুভ্ৰ হঠাৎ একটু নড়েচড়ে বসল। তার বেঞ্চের এক কোনায় অল্পবয়েসী। একটা মেয়ে এসে বসেছে; বাচ্চা মেয়ে। পনেরো-ষোল বছরের বেশি বয়স হবে। না। মেয়েটা এত রাতে পার্কে কী করছে কে জানে! তবে মেয়েটা বেশ সহজস্বাভাবিক। তার সঙ্গে লাল রঙের ভ্যানিটিব্যােগ। সে ব্যাগ খুলে একটা লিপষ্টিক বের করল। আয়না বের করল। এখন সে আয়োজন করে ঠোঁটে লিপষ্টিক দিচ্ছে। এত রাতে মেয়েটা সাজগোজ শুরু করেছে কেন কে জানে! শুভ্র আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। এখন সে কপালে একটা লাল রঙের টিপ দিয়ে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইজান দেখেন তো টিপটা মাঝখানে পড়ছে?
শুভ্ৰ বলল, হ্যাঁ।
মেয়েটা শুভ্রর দিকে পুরোপুরি ফিরে বলল, এই পরথম টিপ মাঝখানে পড়ছে। সবসময় আমার টিপ হয় ডাইনে বেশি যায়, নয় বাঁয়ে বেশি যায়। এর ফলাফল খুব খারাপ। ফলাফল কী জানেন?
না।
ফলাফল সতিনের সংসার।
শুভ্র বলল, এত রাতে তুমি এখানে কী করছ?
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, এত রাইতে এইখানে কী করি আপনে বুঝেন না?
শুভ্র বলল, না। তবে তোমার উচিত বাসায় চলে যাওয়া। ঢাকা শহরে অনেক দুষ্টলোক থাকে। তুমি যদি চাও আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারি।
মেয়েটা বলল, আমার চড়নদার লাগে না। আপনে পার্কে আসছেন কী জন্যে? মেয়েমানুষের সন্ধানে আসেন নাই?
শুভ্ৰ অবাক হয়ে বলল, মেয়েমানুষের সন্ধানে কেন আসব? আমার মা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। কাজেই আমি পার্কে বসে আছি।
মেয়েটি বলল, আমারও আপনার মতো অবস্থা। আমার বাবা-মাও আমারে বাইর কইরা দিছে। বলছে, রোজগার কইরা খা। আমি রোজগারে বাইর হইছি। এখন বুঝেছেন?
শুভ্র বলল, না। তোমার নাম কী?
ফুলকুমারী।
বাহ, নামটা তো খুব সুন্দর।
ব্যবসার জন্যে এই নাম নিছি। আসল নাম মর্জিনা।
শুভ্ৰ বলল, তোমার কিসের ব্যবসা?
মর্জিনা বলল, কিসের ব্যবসা আপনার না জানলেও চলবে। খাওয়াদাওয়া করেছেন?
দুপুরে খেয়েছি। রাতে কিছু খাই নি।
ক্ষিধা লাগছে?
হ্যাঁ। মানিব্যাগ রেখে এসেছি তো। ক্ষিধে লাগলেও কিছু খেতে পারব না।
চলেন আমার সাথে।
শুভ্ৰ বলল, কোথায় যাব?
মর্জিনা বলল, আপনারে খানা খাওয়াব। খাবেন গরিবি খানা?
খাব।
বাপজান রান্ধে। সে ভালো বাবুর্চি। আগে রিকশা চালাইত। ঠ্যাং কাটা পড়ায় ঘরেই থাকে। আমার জন্যে রান্ধে। তার হাতের পাক খাসির মাংস যদি খান জীবনে ভুলবেন না। আপনার নাম কী?
শুভ্র।
দুজন হাঁটছে। শুভ্র যাচ্ছে মেয়েটার পেছনে পেছনে। তার যে এতটা ক্ষিধে লেগেছে তা সে বুঝতে পারে নি।
মর্জিনা বলল, আপনার সাথে আমি ভাই পাতাইলাম। ঠিক আছে?
শুভ্র বলল, অবশ্যই ঠিক আছে। এবং আমার ধারণা তুমি খুবই ভালো একটা মেয়ে। অচেনা একজনকে ভাত খাওয়ানোর জন্যে নিয়ে যাচ্ছ।
অচেনা হবেন কী জন্যে? আপনার সাথে ভাই পাতাইলাম না? আমার কী ধারণা জানেন, বাসায় গিয়া দেখব বাপজান খাসি পাকাইছে। খাসি আর পোলাও।
এরকম ধারণা হলো কেন?
মর্জিনা বলল, আল্লাপাক মানুষ বুইঝা রিজিক বাটে। আপনেরো খাইতে নিতেছি—এইটাও আল্লাপাকের ইশারা।
তুমি খুব আল্লাহভক্ত মেয়ে?
জি ভাইজান।
তোমার বাসা কোথায়?
প্রায় চইলা আসছি। আমরা পাইপের ভিতর থাকি। তিনটা পাইপ ভাড়া নিছি। একটাত বাপজান থাকে, একটাত আমি, আরেকটা থাকে খালি। তয়। বিছানা পাতা আছে। শীতলপার্টি আছে, কোলবালিশ আছে, হাতপাখা আছে।