রাহেলা থমথমে গলায় বললেন, বারবার তুমি এই কথা মনে করিয়ে দাও কেন?
তোমাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্যেই করি। বড় ধরনের ক্যালামিটার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি দরকার মানসিক প্রস্তুতি থাকে না বলেই আমরা কোনো বিপদের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারি না।
তুমি পার?
হ্যাঁ, আমি পারি।
রাহেলার মাথা ঘুরে উঠল। তিনি ক্ষীণ স্বরে বললেন, আমার কেমন জানি লাগছে!
ইয়াজউদ্দিন রাহেলার হাত ধরে ফেললেন। ঠাণ্ডা হাত। সেই হাত থরথর করে কাঁপছে।
রাত বাজে দুটার মতো
রাত বাজে দুটার মতো।
কথা ছিল সারা রাত সবাই জেগে থাকবে। হৈচৈ করতে করতে যাবে। মনে হচ্ছে সবার উৎসাহে ভাটা পড়েছে। বল্টু গোড়া থেকেই মনমরা ছিল। তার মনমরা ভাব রাত একটার দিকে কাটল। সে মোতালেবের কাছ থেকে ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে ফুল ভলু্যমে ক্যাসেট চালু করল। বন্যার রবীন্দ্রসঙ্গীত। তবে ক্যাসেটে দোষ আছে। মনে হচ্ছে বন্যার গলায় ল্যারিনজাইটিস। ভাঙা গলায় গান—
সখী বয়ে গেল বেলা
শুধু হাসি খেলা আর কি ভাল লাগে?
চশমাপরা দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক হঠাৎ পেছন থেকে উঠে এসে কঠিন গলায় বললেন, আপনি কি গান বন্ধ করবেন?
বল্টু বলল, কেন বন্ধ করব?
বন্ধ করবেন, কারণ, রাত দুটা বাজে। এখন গানের সময় না। এখন ঘুমুবার সময়।
আপনার জন্যে ঘুমুবার সময়। আপনি কোলবালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমাদের এখন জেগে থাকার সময়।
চশমাওয়ালা লোক সমর্থনের আশায় চারদিকে তাকাচ্ছে। কাজেই সমর্থন পাবার আগেই বল্টুকে সাপোর্ট দেবার জন্যে মোতাবেল বলল, গালের পরপরেই আছে নৃত্যানুষ্ঠান। আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ। আমাদের দলে কয়েকজন নৃত্যশিল্পী আছেন। নইমা, নাচের জন্যে তৈরি হও।
নইমার জন্যে অত্যন্ত অপমানসূচক কথা। তার বিশাল শরীরের দিকে লক্ষ করেই তাকে নৃত্যশিল্পী বলা হচ্ছে। অতিবড় বোকাও এটা বুঝবে। নইমার পাশে নীরা বসেছিল। সে খিলখিল করে হাসতে শুরু করেছে, যেন এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রসিকতা সে এইমাত্র শুনল।
চশমাপরা ভদ্রলোক বললেন, আপনারা আমাদের সারারাত বিরক্ত করবেন, তা তো হয় না।
বল্টু বলল, প্রতিরাতেই যে ঘুমতে হবে তার কি কোনো মানে আছে? একটা রাত না ঘুমিয়ে দেখুন কেমন লাগে। খারাপ লাগবে না।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে রানা উঠে বলল, নো মিউজিক। গান বন্ধ। অন্য যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধাও আমাদের দেখতে হবে।
সে চশমাপরা লোকের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ওল্ড ব্রাদার, নো অফেন্স। যান, শুয়ে পড়ুন।
মোতালেবের গা জ্বলে গেল। ট্রেন ছাড়ার পর থেকেই রানা এই আলগা মাতব্বরিটা করছে। সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। কষে এর পাছায় একটা লাথি বসিয়ে দেয়া দরকার। লোকজনের সামনেই দেয়া দরকার, যাতে গাধাটার একটা শিক্ষা হয়। মাতব্বর!
মুনা জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখছিল। অন্ধকারে দেখার কিছু নেই, তবু ভালো লাগছিল। ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিও দেখা যাচ্ছে না। তবে বৃষ্টির শব্দ শুনতে খুব সুন্দর লাগছে। চলন্ত ট্রেন থেকে বৃষ্টির শব্দ যে এত সুন্দর লাগে কে জানত?
রানা এসে খট করে মুনার জানালা বন্ধ করে বলল, নো বৃষ্টিতে ভিজাভিজি। ঘুমা। ঘুমিয়ে পড়া।
রানা এসে বসল। সঞ্জুর পাশে। সঞ্জুকে খুব মনমরা লাগছে। দলের কেউ কোনো কারণে বিষণ্ণ হলে সেটা দেখার দায়িত্বও তার।
কী হয়েছে রে সঞ্জ?
কই, কিছু হয়নি তো।
মন-খারাপ করে বসে আছিস কেন? কী হয়েছে বল।
কিছু হয় নি।
মুনা লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়েছে এইজন্যে মন খারাপ? বাদ দে, বাচ্চা মেয়ে, মিসটেক করে ফেলেছে। হেভি বকা দিয়ে দিয়েছি। তুই যদি মুখ ভোঁতা করে রাখিস—তাহলে মুনা ভাববে তার জন্যে তোর মন খারাপ। এই কাজটা সে করল কী করে তাই আমি এখনো বুঝতে পারছি না। এমন তো না যে বেকুব মেয়ে… নে সঞ্জু, সিগারেট নে।
সঞ্জু সিগারেট নিল। মুনা কী জন্যে লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠেছে তা সে না জানলেও অনুমান করতে পারছে। জন্যে তার খুব মায়া লাগছে।
বি হ্যাপি সঞ্জু, বি হ্যাপি। মন খারাপ করে থাকবি না। আমি যাই, টিটির সঙ্গে ম্যানেজ করে আসি। টাকা খাইয়ে আসি।
টাকা খাওয়াবি কেন?
আমাদের মধ্যে দুজন আছে না টিকেট ছাড়া? টাকা না খাওয়ালে হবে কীভাবে? আমি অবশ্যি প্ৰিলিমিনারি আলাপ করে রেখেছি। চোখ-টিপি দিয়ে দিয়েছি। এইসব লক্ষ রাখতে হবে না? নয়তো চিটাগাং নামতেই ঝামেলায় পড়ে যেতাম। আমি ম্যানেজ না করলে এতসব ঝামেলা তোরা মেটাবি কী করে? তোরা তো আবার সব ভদ্রলোক। এই দেখ না, বৃষ্টি হচ্ছে অথচ সবার জানালা খোলা। ঠাণ্ডা লেগে বুকে কফ বসে গেলে অবস্থাটা কী হবে? কোথায় পাব ডাক্তার? কোথায় পাব অষুধ?
রানা ব্যস্ত পায়ে উঠে চলে গেল। রানা চলে যেতেই মুনা আবার তার জানালা খুলে দিল। জানালা খোলার সময় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। সঞ্জও হাসল।
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।
জরীর পাশের জানালা খোলা। বৃষ্টির ছাট আসছে। আনুশকা বলল, জরী, তুই ভিজে যাচ্ছিস। জানালা বন্ধ করে দে।
জরী বলল, আমার ভিজতে ভালো লাগছে।
অসুখ বাধাবি; নিউমোনিয়া হবে। আমাদের সব প্রোগ্রাম বানচাল হবে।
সেটাও মন্দ না। মানুষের জীবনে প্রোগ্রাম ছাড়া কিছু কিছু অংশ থাকা দরকার। যে অংশে আগেভাগে কিছু ভাবা হবে না। যা হবার হবে।
আনুশকা হাসিমুখে বলল, এটা কি কোনো দার্শনিক তত্ত্ব?