শুভ্ৰ কি ট্রেনে ঠিকমতো উঠেছে?
জি আম্মা।
ওর বন্ধুরা সব ছিল?
জি, ছিল।
শুভ্ৰ তোমাকে দেখতে পায় নি তো?
জি না। ছোট ভাইজানের চোখে চশমা ছিল না।
রাহেলা হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই গাধা কী বলছে। চোখে চশমা ছিল না। মানে কী? গাধাটা কি জানে না চশমা ছাড়া শুভ্ৰ অন্ধ? নিজেকে সামলে নিয়ে সহজ ভঙ্গিতে রাহেলা বললেন, চোখে চশমা ছিল না?
জি না।
চশমা ছাড়া সে ট্রেনে গিয়ে উঠল কীভাবে?
একজন সুন্দর মতো আপা উনার হাত ধইরা টেরেইনে নিয়ে তুলছেন।
তুমি জিজ্ঞেস করো নি আপনার চশমা কোথায়?
জি না। আপনে বলছেন দূর থাইক্যা দেখতে।
গাধাটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। রাহেলা দোতলায় উঠে এলেন। এইটুকু সিঁড়ি ভাঙতেই তাঁর দম আটকে আসছে। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে যাবেন। মধুর মাকে দিয়ে খবর পাঠালেন যেন ডাক্তার আনা হয়। ঘড়ি দেখলেন, শুভ্রর বাবার আসার সময় হয়েছে। তাঁর সঙ্গে কথা বললে রাহেলার মনের অস্থিরতা কিছুটা কমবে। মানুষটা হয়তো যুক্তি দিয়ে বোঝাবে, চশমা ছাড়া শুভ্রের তেমন অসুবিধা হবে না। কিংবা কোনো ব্যবস্থা করবে যেন ট্রেনেই শুভ্র চশমা পেয়ে যায়। সুন্দরমতো একজন আপা শুভ্রের হাত ধরে টেনে তুলেছে। সেই সুন্দরমতো আপাটা কে? শুভ্রর কোনো মেয়েবন্ধু আছে বলে তিনি জানেন না। এ বাড়িতে মেয়েরা কখনো আসে নি। কারো সঙ্গে ভাব থাকলে শুভ্ৰ নিশ্চয়ই তাকে এ বাড়িতে আসতে বলত। রাহেলার খুব শরীর খারাপ লাগছে। আবার পিপাসা হচ্ছে। হাত কাঁপছে।
শুভ্রর বাবা বাড়ি ফিরলেন রাত বারোটা দশ মিনিটে। এত রাতে তিনি কখনো বাড়ি ফিরেন না। তাঁর টঙ্গী সিরামিক্স কারখানার সমস্যা হচ্ছে বলে গত কয়েক রাত ফিরতে দেরি হচ্ছে।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব দোতলায় উঠে দেখলেন শুভ্রর ঘরে বাতি জুলছে। তিনি বিস্মিত হয়ে উঁকি দিলেন। শুভ্রর বিছানায় রাহেলা পা তুলে বসে আছেন। রাহেলার মাথার চুল ভেজা। মনে হচ্ছে কিন্তু আগেই মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, কী ব্যাপার?
রাহেলা ক্ষীণ গলায় বললেন, শুভ্র তার চশমা হারিয়ে ফেলেছে।
শুভ্রের কথা জানতে চাচ্ছি না। তোমার কী হয়েছে?
আমার খুব অস্থির লাগছে।
প্ৰেশার বেড়েছে?
হুঁ।
ডাক্তার এসেছিল?
হুঁ।
প্ৰেশার এখন কত?
উনি বলেননি। অষুধ খেতে দিয়েছেন।
খেয়েছ?
হুঁ।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব চেয়ার টেনে রাহেলার মুখোমুখি বসলেন।
ভাত খেয়েছ রাহেলা?
না।
উঠে খাবার দিতে বলো। আমি গোসল করে চারটা খাব। খাবার টেবিলে কথা হবে। শুভ্রের চশমার ব্যাপারে এত চিন্তিত হবার কিছু দেখছি না। তুমি কি ওকে বাড়তি চশমা দাওনি?
ওর হ্যান্ডব্যাগে দুটা আছে। কিন্তু ওকে তো বলা হয়নি।
না বললেও অসুবিধে হবে না। একসময়-না এক-সময় ও ব্যাগ খুলবে। ব্যাগ খুললেই পেয়ে যাবে।
রাহেলা ফিসফিস করে বললেন, যদি ব্যাগটা হারিয়ে ফেলে? চোখে তো এখন দেখছে না। নিজের ব্যাগ চিনবে কী করে?
ইয়াজউদ্দিন সাহেব ধৈর্য হারালেন না। শান্ত গলায় বললেন, চিটাগাং নেমে নতুন চশমা বানিয়ে নেবে। প্রেসক্রিপশন সবসময় শুভ্রর মানিব্যাগে থাকে। থাকে না?
হুঁ।
নামো তো বিছানা থেকে। নামো।
আমার খুব অস্থির লাগছে।
শোনো রাহেলা, আমি বরং এক কাজ করি। আমাদের চিটাগাং অফিসের সিদ্দিককে বলে দিই, সে ভোরবেলা চিটাগাং রেল স্টেশনে যাবে এবং শুভ্ৰকে বলবে, তার হ্যান্ডব্যাগের সাইড পকেটে চশমা আছে।
আচ্ছা।
তোমার অস্থিরতা কি এখন একটু কমেছে?
রাহেলা জবাব দিলেন না। ইয়াজউদ্দিন সাহেব শান্ত গলায় বললেন, আমি ট্রেনে একজন লোক রেখেছি। সে সবসময় শুভ্রের উপর লক্ষ রাখবো। তোমাকে এই খবরটা জানাতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু প্ৰেশার-ট্ৰেশার বেড়ে তোমার যা অবস্থা হয়েছে, আমার মনে হল জানানো উচিত।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। স্ত্রীর হাত ধরে তাঁকে নিচে নামালেন। রাহেলা বললেন, মজিদ বলছিল, সুন্দরমতো একটা মেয়ে নাকি শুভ্রের হাত ধরে তাকে ট্রেনে নিয়ে তুলছে।
ভালই তো। সমস্যার সময়ে বন্ধুর মতো কাউকে কাছে পাচ্ছে।
আমার কেন জানি খুব খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটবে।
ভয়ংকর কিছুটা কী হবে বলে মনে করছ?
ওরা সমুদ্রে নামবে, তারপর চোরাবালিতে আটকে যাবে।
ও তো একা যাচ্ছে না। ওর আট-নজন বন্ধু আছে। একজন চোরাবালিতে আটকালে অন্যরা টেনে তুলবে।
বিপদের সময় কাউকে কাছে পাওয়া যায় না।
ঐ মেয়েটিকে পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা।
কোন মেয়ে?
ইয়াজউদ্দিন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, সুন্দরমতো মেয়েটি। যে শুভ্রের হাত ধরে তাকে ট্রেনে তুলে নিল। তুমি এখনো এত অস্থির হয়ে আছ কেন? যাও, নিচে গিয়ে খাবার গরম করতে বল। আমি চিটাগাং টেলিফোন করছি।
ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে আমিও কথা বলব।
তোমার কথা বলার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। যা বলার আমি গুছিয়ে বলব।
চশমাটা আছে ওর হ্যান্ডব্যাগের ডান দিকের পকেটে। ডিসপোসেবল রেজার, শেভিং ক্রম, সাবান, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ সব আছে বাঁ দিকের পকেটে।
আমি বলে দেব।
রাহেলা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, শুভ্রের জন্যে আমার এই যে ভীতি, তোমার কাছে তা কি অস্বাভাবিক মনে হয়?
ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, না। অন্য সবার কাছে মনে হবে তুমি বাড়াবাড়ি করছি। কিন্তু আমার কাছে মনে হবে, না। কারণ অন্যরা জানে না, কিন্তু আমরা জানি, শুভ্রের চোখের নার্ভ শুকিয়ে আসছে। অতিদ্রুত তার চোখ নষ্ট হয়ে যাবে। সে কিছুই দেখবে না।