বুফেকার বন্ধ।
এখানে আসার পথে দেখলাম টি-পটে চা নিয়ে ফার্স্ট ক্লাসের দিকে যাচ্ছে।
আগে অর্ডার ছিল।
ভাই, আমরা গল্পগুজব করতে করতে ছুটি কাটাতে যাচ্ছি। দেন না। দশটা টাকা না হয় বেশি রাখেন। নো প্রবলেম।
বললাম তো, হবে না।
এরা আমাদের দুজনকে আশা করে পাঠিয়েছে। এর নাম শুভ্ৰ। অতি ভালো ছেলে। শুভ্রর প্রেস্টিজের একটা ব্যাপারও আছে। চা নিয়ে যেতে না পারলে মেয়েগুলির সামনে শুভ্রর মান থাকবে না।
এক কথা কয়বার বলব? আপনারা কেন বিরক্ত করছেন?
তাহলে কি এদের নিয়ে উঠে চলে যাব?
সেটা আপনার ইচ্ছা।
ভাইজান, আমরা কিন্তু মানুষ ভালো না। এখন আমরা দুইজন আপনার গায়ে থুথু দেব। থু করে একদলা থুথু ফেলব।
হতভম্ব ম্যানেজার বলল, কি বললেন?
আপনার গায়ে থুথু ফেলব।
ফাজলামি করছেন নাকি?
জি না ব্রাদার, ফাজলামি করছি না।
শুভ্ৰ, এর গায়ে থুথু ফেল তো।
শুভ্ৰ সঙ্গে সঙ্গে থু করে থুথু ফেলল। এবং থুথু ফেলে তার নিজেরই বিস্ময়ের সীমা রইল না। এটা সে কি করল? কীভাবে করতে পারল?
ম্যানেজার লোকটা কী অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে!
শুভ্র করুণ চোখে তাকাল মোতালেবের দিকে।
মোতালেব সহজ গলায় বলল, এখন আমরা যাই। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে যাই। আরো পনেরো মিনিট অপেক্ষা করব। পনেরো মিনিটের মধ্যে যদি চা না আসে তা হলে ট্রেনের দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে তোকে নিচে ফেলে দেব। আমার ভাল নাম মোতালেব। বন্ধুরা বলে মোতা মিয়া। একবার এক পাজীর গায়ে পিসাব করে দিয়েছিলাম। সেই থেকে মোতা মিয়া নাম।
মোতালেবরা জরীদের কাছে ফিরে গেল। জরী বলল, চা আসছে?
মোতালেব বলল, বুঝতে পারছি না। তবে সম্ভাবনা আছে। অষুধ দিয়ে এসেছি। অষুধে কাজ হবে কি না জানি না। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। আবার উল্টা অ্যাকশনও হতে পারে।
অষুধটা কী?
মাইল্ড ডোজের সালফা ড্রাগ দেয়া হয়েছে। সালফা ড্রাগে কাজ না হলে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হবে। ব্ৰড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক।
জরী বলল, শুভ্রর মুখটা এমন মলিন লাগছে কেন? কী হয়েছে শুভ্র?
শুভ্ৰ জবাব দিল না। চোখ নিচে নামিয়ে নিল। লজ্জায় সে মাথা তুলতে পারছে না।
আনুশকা বলল, আচ্ছা শুভ্ৰ, এই লাইন দুটা কোথায় আছে বলতে পারবে?
পায়ে ধরে সাধা
রা নাহি দেয় রাধা।
শুভ্ৰ ক্ষীণ গলায় বলল, গল্পগুচ্ছে আছে।
গল্পের নাম কী?
গুপ্তধন।
Thank you learned কানাবাবা। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
প্ৰশংসাবাক্যেও শুভ্রের কিছু হল না। তার মুখ মলিন হয়েই রইল। তার শুধু মনে হচ্ছে, যদি কোনোদিন মা এই ঘটনা জানতে পারেন তার কেমন লাগবে? মা অবশ্যই জানতে চাইবেন সে কেমন করে এই কাজটা সে করল? তখন সে কী বলবে? কিংবা মা হয়তো কিছুই জানতে চাইবেন না। শুধু শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকবেন। সে তো আরো ভয়াবহ।
শুভ্রর মা রাহেলা
শুভ্রর মা রাহেলার ব্লাডপ্ৰেশার হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে দাঁত মাজছিলেন, হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠল। তিনি দেয়াল ধরে টাল সামলালেন। এরকম অবস্থায় কোথাও বসে যাওয়া উচিত। আশেপাশে বসার কিছু নেই। বসতে হলে মেঝেতে বসতে হয়। রাহেলা ক্ষীণ স্বরে ডাকলেন, মধুর মা, মধুর মা!
মধুর মা একতলায় ছিল। রাহেলার গলার স্বর এতদূর পৌঁছানোর কথা না, কিন্তু মধুর মার কান খুব পরিষ্কার। সে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল। রাহেলা প্ৰায় ফিসফিস করে বললেন, বেতের চেয়ারটা এনে দাও। বসব। আমার মাথা ঘুরছে।
মধুর মা বেতের চেয়ার এনে দিল।
বরফ মিশিয়ে আমাকে ঠাণ্ডা এক গ্রাস পানি দাও।
শরীর বেশি খারাপ আম্মা? ডাক্তার খবর দিব?
ডাক্তার লাগবে না। শুভ্রের ঘরে বাতি জ্বলছে কেন? বাতি জ্বালাল কেন? যাও, বাতি নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে আসো। পানি পরে আনবে।
দরজায় তালা দিমু আম্মা?
হ্যাঁ, তালা দাও।
মধুর মা শুভ্রের ঘরে ঢুকল। রাহেলা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। শুভ্রের ঘরে কেউ ঢুকলে তাঁর ভাল লাগে না। শুভ্ৰ বাড়ি ছেড়ে গেছে তিন ঘণ্টাও হয়নি। তার কাছে মনে হচ্ছে অনন্তকাল পার হয়ে গেছে। এই প্রথম শুভ্রের বাড়ি ছেড়ে বাইরে যাওয়া। শুভ্ৰ আর দশটা ছেলের মতো হলে তিনি এতটা বিচলিত হতেন না। সে আর দশটা ছেলের মতো নয়। চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললে সে কিছুই দেখে না। একজনকে সারাক্ষণ তার চশমা খুঁজে দিতে হয়। তার ওপর শুভ্রের চশমা-ভাঙা রোগ আছে। অকারণে হেঁচটি খেয়ে পড়ে চশমা ভেঙে ফেলবে। তিনি অবশ্যি শুভ্রের ব্যাগে দুটি বাড়তি চশমা দিয়ে দিয়েছেন। প্রয়োজনের সময় সেই চশমা দুটি শুভ্ৰ কি খুঁজে পাবে?
মধুর মা গ্লাসে করে হিম-শীতল পানি নিয়ে এল। এক চুমুক পানি খেয়েই রাহেলার মনে হলো, তাঁর আসলে পিপাসা পায় নি। রাহেলা বললেন, মজিদ কি এসেছে মধুর মা?
জি আসছে।
কতক্ষণ হলো এসেছে?
অনেকক্ষণ।
আমাকে বলোনি কেন?
রাহেলা উঠে দাঁড়ালেন। তার মাথা অবশ্য এখনো ঘুরছে। আজ সকালে ব্লাড-প্রেশারের অষুধ কি তিনি খেয়েছেন? রাহেলা মনে করতে পারলেন না। মজিদকে পাঠাতে হবে ডাক্তার সাহেবকে আনার জন্যে। রাহেলার এক দূর সম্পর্কের চাচা তাঁর ডাক্তার। ওঁর বাসায় টেলিফোন নেই, খবর দিতে কাউকে পাঠাতে হয়।
মজিদ, তুমি কখন এসেছ?
অনেকক্ষণ হইল আসছি।
খবর দাওনি কেন?
মজিদ অন্যদিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে। এ বাড়ির সব কটা কাজের মানুষ এমন গাধা কেন? মজিদকে স্টেশনে পাঠানো হয়েছিল দূর থেকে দেখার জন্যে শুভ্র ঠিকমতো ট্রেনে উঠতে পারল কি-না। এই খবর সে বাসায় এসে দেবে না?