তুই তখন কী করলি?
কঠিন গলায় ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম। তারপর গাড়ির দরজা খুলে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম।
কী ঘটেছিল বাসার সবাইকে বললি?
হ্যাঁ, বিয়ে ভেঙে দেয়ার জন্য আমি আমার বড় চাচার পা পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। বড় চাচা রাজি হলেন না, কারণ ছেলের নাকি মস্তানদের সঙ্গে ভাল কানেকশন। এরকম কিছু করলে ভয়ংকর ক্ষতি হবে।
জেনেশুনে তোর বড় চাচা এমন একজন ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে ঠিক করলেন?
হ্যাঁ, করলেন। কারণ ঐ ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হলে চাচার ব্যবসার সুবিধা হয়।
বিয়ের আসর থেকে তুই পালিয়ে এলি কীভাবে?
বড় চাচী ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে বসেছিলাম। বড় চাচী পালিয়ে যেতে বললেন।
আগে তো শুনেছিলাম, তোর এই চাচী তোকে দেখতে পারে না।
মানুষকে চট করে চেনা যায় না, আনুশকা। এই চাচী আমাকে সত্যি সত্যি অপছন্দ করতেন। সারাক্ষণ কঠিন সব অপমান করতেন। আমরা যে তাঁর বাড়ির আশ্রিত অন্নদাস এই কথা দিনের মধ্যে খুব কম হলেও দশবার মনে করিয়ে দিতেন। অথচ এই তিনিই আমার চরম দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমার মা আমার পাশে এসে দাঁড়াল না, আমার বাবাও না। কে পাশে এসে দাঁড়াল? আমার বড় চাচী।
আনুশকা বলল, চার ব্যাপারটা মন থেকে তাড়াতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এক কাপ চা খেতে না পারলে মারা যাব। কী করা যায় বল তো?
জরী বলল, এখন আর শুধু একটা জিনিসই করা যেতে পারে। ঐ লোকটার পায়ে ধরা। সেটা কি ঠিক হবে? সামান্য এক কাপ চায়ের জন্যে পা ধরা? তাও যদি সুন্দর পা হত একটা কথা ছিল।
আনুশকা অন্যমনস্ক গলায় বলল, পায়ে ধরে সাধা, রা নাহি দেয় রাধা—এই দুটা লাইন রবীন্দ্রনাথের কোন গল্পে আছে বল তো?
জানি না। বলতে পারব না। হঠাৎ কবিতার লাইন কেন?
আনুশকা বলল, তোর পায়ে ধরার কথা থেকে মনে এল। আমাদের মন বিচিত্ৰ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছোটাছুটি করে।
গল্পগুচ্ছে আছে জানি, কিন্তু কোন গল্প মনে পড়ছে না। আমার কিছু মনে না এলে খুব অস্থির লাগে। মাথায় চাপা যন্ত্রণা হয়। আমার ইচ্ছা করছে ডেকে ডেকে সবাইকে জিজ্ঞেস করি।
হ্যালো ম্যানেজার সাহেব, বলুন তো পায়ে ধরে সাধা, রা নাহি দেয় রাধা-এই লাইন দুটো রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের কোন গল্পে আছে?
ম্যানেজার কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। জরী বলল, শুভ্র বলতে পারবে। যদি কেউ জানে শুভ্ৰ জানবে।
শুভ্ৰ শুকনো মুখে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেট ধরানোর অস্বস্তিতে সে প্ৰায় মরে যাচ্ছে। মোতালেবের চাপাচাপিতে এটা করতে হয়েছে। মোতালেব হুঙ্কার দিয়ে বলেছে-খাবি না মানে? খেতে হবে। গুড বয় হয়ে অনেক দিন পার করেছিস। আর না। এখন আমরা ব্যাড বয় হব।
ব্যাড বয় হলে সিগারেট খেতে হবে?
অবশ্যই খেতে হবে। সিগারেট খেতে হবে। গাঁজা খেতে হবে। শার্টের বুকের বোতাম খোলা রাখতে হবে। মেয়েরা আশেপাশে থাকলে অশ্লীল রসিকতা করতে হবে। খোল, শার্টের বুকের বোতাম খোল, যাতে বুকের লোম দেখা যায়। তোর বুকে লোম আছে?
শুভ্রর চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। মোতালেব বলল, লজ্জায় তুই দেখি টমেটোর মতো হয়ে গেছিস। ফুসফুস ভর্তি করে সিগারেটের ধোঁয়া নে, দেখবি লজ্জা কেটে যাবে। লাজুক মানুষ এইজন্যেই সিগারেট বেশি খায়। লজ্জা ঢাকার জন্যে খায়। গাঁজা খেলে কী হয় জানিস?
না।
লজ্জা বেড়ে যায়। গাঁজা হলো লজ্জা বর্ধক। বিরাট বডিবিল্ডারও দেখবি গাজার কল্কেতে টান দিয়ে মিহি মেয়েলি গলায় কথা বলবে। গাঁজার অন্য মজা।
শুভ্ৰ বলল, তুই গাঁজা খেয়েছিস?
অবশ্যই খেয়েছি। গাঁজা খেয়েছি। কালিপূজার সময় ভাং-এর যে সরবত করে তাও খেয়েছি। ভাং-এর সরবত খেলে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হয়। কী হয় শুনতে চাস?
চাই।
এই তো পথে আসছিস। আমার ধারণা ছিল তুই বলবি শুনতে চাই না। দাঁড়া, তোকে বলব। কী হয়। তার আগে জরী আর আনুশকাকে নিয়ে আসি। ওরা কোথায়?
চা খেতে গিয়েছে বুফেকারে।
চল, ওদের নিয়ে আসি। ভাং খেলে কী হয় এটা শুনলে মেয়েরা খুব মজা পায়। এটা বলতে হবে মেয়েদের সামনে।
শুভ্রর খেতে ইচ্ছা করছে না। সিগারেট হাতে নিয়ে হাঁটতে লজা-লজা লাগছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, সে কোনো অপরাধ করে ফেলেছে এবং মা পরিষ্কার দেখছেন। এক্ষুনি যেন তিনি বলবেন, শুভ্র বাবা, তোমার হাতে কী?
মোতালেব বলল, সবাই মিলে ছাদে বসে যেতে পারলে ইন্টারেস্টিং হতো। ট্রেনের ছাদে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকলে দারুণ লাগে।
শুভ্ৰ বলল, ভয় লাগে না?
প্রথম দুতিন মিনিট ভয় লাগে। তারপর আর লাগে না। আনুশকা ওদের দেখেই বলল, ঐ ম্যানেজার আমাদের চা দিচ্ছে না। আধ ঘণ্টার মতো বসে আছি। একটু বলে দেখো না।
মোতালেব বলল, তোমার মতো রূপবতীকে চা দেয় নি, আমাকে দেবে? হাতি-ঘোড়া গেল তল, মোতালেব বলে কত জল?
তোমার তো অনেক টেকনিক আছে।
আচ্ছা দেখি। একটা নিউ টেকনিক অ্যাপ্লাই করে দেখি। শুভ্ৰ, তুই আয় আমার সঙ্গে। এই টেকনিকে ম্যান পাওয়ার লাগে।
শুভ্ৰ বাধ্য ছেলের মতো রওনা হলো। সে ভেবেছিল, তার হাতে সিগারেট দেখে জরী বা আনুশকা কিছু বলবে। তারা কিছু বলে নি। শুধু জরী সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসে। বাচ্চা ছেলে বাবার জুতায় পা ঢুকিয়ে হাঁটার চেষ্টা করলে মারা যেমন ভঙ্গিতে হাসে সেই ভঙ্গির হাসি।
মোতালেব কাঁচুমাচু মুখে ম্যানেজারকে বলল, ভাইজান, রূপবতী দুই মহিলা আধা ঘণ্টার উপর বসে আছে। এদের চা দিচ্ছেন না কেন?