আনুশকা বলল, এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যাবার ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং কেন বল তো?
জানি না।
প্রতিটি কামরার আলাদা অস্তিত্ব আছে। এক-একটি কামরা পার হচ্ছি, আর মনে হচ্ছে—আমরা আলাদা অস্তিত্ব অতিক্রম করে করে এগুচ্ছি।
হুঁ।
তুই আমার কথা কিছুই শুনছিস না। মন দিয়ে শুনলে হেসে ফেলতি। কারণ আমি খুব সস্তা ধরনের ফিলসফি করছি।
আচ্ছা।
বুফেকারের ম্যানেজার বলল, কাটলেট আর বোম্বাই টোস্ট ছাড়া কিছু নেই।
আনুশকা বলল, কাটলেট এবং বোম্বাই টোষ্ট খাবার জন্যে আমরা আসি নি। আমরা চা খেতে এসেছি।
চা নাই। ওভালটিন আছে।
ওভালটিন, ওভালটিন কে খায়? বাংলাদেশ হচ্ছে চায়ের দেশ। এখানে পাওয়া যাবে চা। বিদেশিদের জন্যে কফি। ওভালটিন কেন?
ম্যানেজার হাই তুলল। জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করল না। ওভালটিন বিক্রি করলে লাভ অনেক বেশি থাকে। এই তথ্য মেয়ে দুটিকে দেবার তার প্রয়োজন নেই। আনুশকা বলল, ভাই, আপনি এমন বিশ্ৰী করে হাই তুলবেন না। আমরা চা খেতে এসেছি। চা খাব। আপনি কোত্থেকে জোগাড় করবেন তা আপনার ব্যাপার।
এগারোটার পর সার্ভিস বন্ধ।
বন্ধ সার্ভিস চালু করুন। আমরা ঐ কোণায় বসছি। চা না খেয়ে যাব না। শুনুন, চিনি যেন কম হয়। গাদাখানিক চিনি দিয়ে সরবত বানিয়ে ফেলবেন না।
ম্যানেজারের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে আবার হাই তুলল। চলতি ট্রেনে ছোটখাটো ঝামেলা হয়। এসব পাত্তা দিলে চলে না। চা অবশ্য সে সহজেই দিতে পারে। টি-ব্যাগ আছে, গরম পানি আছে। কিন্তু দরকারটা কী? মেয়ে দুটি খানিকক্ষণ বসে থেকে বিরক্ত হয়ে চলে যাবে। রাগারাগিও হয়তো করবে। করুক না। অসুবিধা কী?
সুন্দরী মেয়ে রাগারগি করলেও দেখতে ভালো লাগে। ম্যানেজার মনে মনে অতি কুৎসিত একটা গালি দিল। সুন্দর সুন্দর মেয়েদের এইসব গালি দিতেও ভালো লাগে। ওদের শুনিয়ে গালিটা দিতে পারলে হয়তো আরো ভালো লাগত। সেটা সম্ভব না।
জরী এবং আনুশকা মুখোমুখি বসেছে। জানালা খোলা। খোলা জানালায় হু হু করে হাওয়া আসছে। এদের শাড়ির আঁচল পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে। আনুশকা বলল, কী বাতাস দেখেছিস?
হুঁ।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ—দারুণ বৃষ্টি হবে। ঝমোঝমিয়ে একটা বৃষ্টি দরকার। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলেই তোর মনের মেঘ কেটে যাবে।
মন বিশেষজ্ঞ হলি কবে থেকে?
অনেক দিন থেকে। আমি নিজেই রোগী, নিজেই ডাক্তার। আমার নিজের মন কীভাবে খারাপ হয়, কীভাবে ভালো হয়, তা আমি মনিটার করি। মনিটার করতে করতে আমার এখন একধরনের ক্ষমতা হয়েছে। মন ভালো করার কৌশল আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না।
বৃষ্টি নামলেই আমার মন ভালো হয়ে যাবে?
ইয়েস ম্যাডাম।
তোর মন হয়তো ভালো হবে। কিন্তু সবার মন তো আর তোর মতো না। আমরা সবাই আলাদা আলাদা।
আলাদা হলেও এক ধরনের মিল আছে। দুঃখ পেলে সবারই মন খারাপ হয়। সবাই কাঁদে। কেউ শব্দ করে, কেউ নিঃশব্দে।
জরী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সবাই যে কাঁদে তা কিন্তু না, কেউ কেউ হোসেও ফেলে।
আনুশকা চুপ করে গেল। জরী বলল, চা কিন্তু এখনো দেয়নি। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে দেবে না। দেখ দেখ, কী বিশ্ৰী করে তাকাচ্ছে!
আনুশকা বলল, কী ব্যাপার, এখনো যে চা আসছে না?
ম্যানেজার বলল, একবার তো বলেছি। এগারোটা বাজে, সব বন্ধ।
আমরা কিন্তু চা না খেয়ে যাব না।
ম্যানেজার মনে মনে তার প্রিয় গালটা দিল। আফসোস, এরা শুনতে পাচ্ছে না। শুনতে পেলে দৌড়ে পালিয়ে যেত। সে যেখানে বসেছে সেখান থেকে মেয়ে দুটিকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। তাতে অসুবিধা নেই। পেছন দিক থেকে একজনের পেটের খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। ফর্সা পেট দেখতে ভালো লাগছে। এখান থেকে অনুমান করা যায় গোটা শরীরটা কেমন।
আনুশকা ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, কী, চা দেবেন না?
ম্যানেজার বলল, না।
আনুশকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না শব্দটা শুনতে কী খারাপ লাগে। লক্ষ করেছিস জরী? এথচ এই শব্দটাই আমরা সবচে বেশি শুনি।
আমরা নিজেরাও প্রচুর বলি।
আমি বলি না। আমি সব সময় হ্যাঁ বলার চেষ্টা করি।
সবার সাহস তো তোর মতো না।
আনুশকা বলল, আমি আসলে কিন্তু ভীতু ধরনের একটি মেয়ে। সবসময় সাহসী মুখোশ পরে থাকি। আমাদের মধ্যে সত্যিকার সাহসী যদি কেউ থাকে, সে হল তুই নিজে।
আমাকে সাহসী বলছিস কেন?
বিয়ের আসর থেকে তুই পালিয়ে এসেছিস। তোর গায়ে এখনো বেনারসী শাড়ি। কটা মেয়ে এই কাজ করতে পারবে?
কাজটা কী আমি ঠিক করেছি?
তা তো আমি বলতে পারব না। তুই বলতে পারবি। আমি বাইরে থেকে তোর ব্যাপারে কি মতামত দেব?
যে ছেলেটার সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছিল,সেই ছেলেটা ভাল না, মন্দ ছেলে।
মানুষের ভাল-মন্দ চট করে বোঝা যায় না। তোর সঙ্গে তো ছেলেটার পরিচয়ই হয়নি। তুই বুঝলি কী মন্দ?
বিয়ের দুদিন আগে সে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাচ্ছিল। গাড়িতে করে যাচ্ছি, হঠাৎ সে আমার গায়ে হাত দেয়। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। আমরা পেছনের সীটে।
গায়ে হাত দেয় মানে কী? হাতে হাত রাখে? যে ছেলে জানে দুদিন পর তোর সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে, সে অবশ্যই তোর হাতে হাত রাখতে পারে। আমি তাতে কোনো সমস্যা দেখি না।
হাতে হাত রাখা নয়। অন্য ব্যাপার, কুৎসিত ব্যাপার। আমি মুখে বলতে। পারব না। এবং এই ব্যাপারটা ড্রাইভারের সামনে ঘটে। ড্রাইভার গাড়ির ব্যাকভিউ মিররে পুরো ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছিল। সে ছিল নির্বিকার, কারণ এ-জাতীয় ঘটনা এই গাড়িতে আরও ঘটেছে। এটা ড্রাইভারের কাছে নতুন কিছু ছিল না।