নানা ধরনের কস্টের মধ্যে আমি বড় হচ্ছি। একধরনের আশা নিয়ে বড় হচ্ছি-গভীর রাতে ঘুম ভেঙে হঠাৎ মনে হয়—হয়তো সামনের দিনগুলি অন্যরকম হবে।
অয়ন ভাই, আমি একটা ঘোরের মধ্যে আপনার সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রেনে উঠে পড়লাম। সবাই আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছিল। আমি কিন্তু একটুও লজ্জা পেলাম না। মনে মনে বললাম—এই ব্যাপারটা নিয়তি সাজিয়ে রেখেছে। নিয়তি চাচ্ছে আমি যাই আপনার সঙ্গে।
রাতে একসময় আপনারা সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি কিন্তু জেগে রইলাম। জেগে জেগে ঠিক করলাম দারুচিনি দ্বীপে নেমে আমি কী করব। কী করব জানেন? আমি আপনার কাছে গিয়ে বলব—অয়ন ভাই, আসুন তো আমার সঙ্গে। আমি এক সময় বলব, আমার কেমন যেন ভয়-ভয় লাগছে। আপনি আমার হাতটা একটু ধরুন তো! আপনি হাত ধরবেন। আর সঙ্গে সঙ্গে আমি বলব।–অয়ন ভাই, আমি আপনাকে নিয়ে এত ঠাট্টা-তামাশা করি। আমি জানি আপনি খুব রাগ করেন। কিন্তু আমি যে আপনাকে কতটা ভালোবাসি তা কি আপনি জানেন? এই সমুদ্রে যতটা পানি আছে, বিশ্বাস করুন অয়ন ভাই, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা তারচে অনেক অনেক গুণ বেশি। অয়ন ভাই, এখন যদি আপনি চলে। যান তাহলে আমি কথাগুলি কীভাবে বলব?
মুনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রানা নীরার সুটকেস নামিয়ে দিচ্ছে। রানা বলল, মুনা, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? উঠে আয়। মুনা উঠে এল।
নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। ইঞ্জিনের ভট্ ভট্ শব্দ হচ্ছে। ভালো দুলুনি হচ্ছে। নীরা হাত নাড়ছে। বল্টু হাত নাড়ছে না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
আনুশকা বলল, যেভাবে মানুষজন কমছে। শেষ পর্যন্ত কজন গিয়ে দারুচিনি দ্বীপে পৌঁছব কে জানে?
নদীর মোহনা ছেড়ে নৌকা সাগরে পড়ল। গাঢ় নীল সমুদ্র।
যেন এক জীবন্ত নীলকান্ত মণি। শুভ্ৰ মুগ্ধ বিস্ময়ে বলল, এত সুন্দর! এত সুন্দর!
বড় বড় ঢেউ উঠতে শুরু করেছে। নৌকা খুবই দুলছে। রানা ভীত গলায় বলল, আমরা সবাই কি মারা পড়ব নাকি? ভয়াবহ অবস্থা দেখি! জরী, তোমার ভয় লাগছে?
জরী বলল, না।
এক-একটা বড় ঢেউ আসছে। পাগলী মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠছে। আনুশকা বলল, এই মেয়েটার একটা নাম দেয়া দরকার। কী নাম দেয়া যায়? মোতালেব, একটা নাম বলো তো!
মোতালেব বলল, নিজে বেঁচে থাকলে তারপর অন্যের নাম। অবস্থা যা দেখছি। বাঁচব বলে তো মনে হয় না। মাঝি ভাই, বলেন তো নৌকা ডোবে কখনও?
মাঝি সহজ, গলায় বলল, ড়ুবে। আকছার ড়ুবে।
নিশ্চয় ঝড়-তুফানের সময় ডোবে। আজ ঝড়-তুফান নেই। তাই না মাঝি?
আশ্বিন মাসে সাগর মাঝেমইধ্যে বিনা কারণে পাগলা অয়। তখন বড়ই সমস্যা।
আজ কি সাগর পাগলা হয়েছে?
হেই রকমই মনে লয়।
রানা বলল, ফিরে যাবার আইডিয়াটা তোমাদের কাছে কেমন মনে হচ্ছে আনুশকা?
খুব খারাপ মনে হচ্ছে। যে ফিরে যেতে চায় তাকে ফিরতে হবে সাঁতার দিয়ে।
মোতালেব বলল, ভয় যে পরিমাণ লাগছে—ভয়ের চোটে একটা কেলেঙ্কারি না করে ফেলি—কিংবা কে জানে হয়তো ইতোমধ্যেই কেলেঙ্কারি করে ফেলেছি। শরীরটা হালকা হালকা লাগছে।
জরী হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ভয়ের মধ্যেও তোমার সেন্স অব হিউমার যে নষ্ট হয় নি সেটা খুব ভালো লক্ষণ না।
আনুশকা বলল, আচ্ছা, আমরা এই মেয়েটার কেউ কোনো নাম দিচ্ছি না। কেন? শুভ্ৰ, তুমি এর একটা নাম দাও—
আমি ওর নাম দিলাম–ঊৰ্মি। ঢেউ।
জরী, তোর মাথায় কি কোনো নাম আসছে?
না, আমার মাথায় কোনো নাম আসছে না। আমার এখন কেমন জানি ভয়ভয় লাগছে। মাঝি, নৌকা উল্টাবে না তো?
সবই আল্লাহর ইচ্ছা আম্মা।
ঢেউয়ের পানি পাহাড়ের মতো সারি বেঁধে ছুটে আসছে। শুভ্ৰ মুগ্ধ বিস্ময়ে বলল, কি সুন্দর, অথচ কী ভয়ংকর!
মাঝি চেঁচিয়ে বলল, নৌকা ধর, গরি ধরিঅরে বইয়। অবস্থা ভালো। ন দেকির।
শুভ্ৰ নৌকা ধরল না। সে চেঁচিয়ে বলল, দেখো দেখো, সমুদ্র-সারস। সমুদ্র-সারস। তারা নৌকাকে ঘিরে বাক বেঁধে উড়ছে। মনে হচ্ছে তারা যাচ্ছে কোনো-এক অজানা দারুচিনি দ্বীপে।
আনুশকা বলল, দ্বীপটা কি দেখা যায়?
মাঝি আঙুল তুলে দেখাল। হ্যাঁ, দেখা যাচ্ছে। ঐ তো দেখা যায়। এত সুন্দর! আশ্চৰ্য, এত সুন্দর!
সারা দিন ঘরেই কাটাবেন
ইয়াজউদ্দিন সাহেব ঠিক করে রেখেছিলেন সারা দিন ঘরেই কাটাবেন। রাতে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়াতে যাবেন। বন্ধুবান্ধবের বাসায় নয়। তেমন কোনো বন্ধুবান্দব তাঁর নেই। গাড়িতে উঠে বসবেন—ড্রাইভারকে বলবেন, ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ে ধরে খানিকক্ষণ যাও। অতি দ্রুত রাস্তায় খানিকক্ষণ ঘুরলে ভালো লাগে। মানুষের জন্মই হয়েছে দ্রুত চলার জন্যে, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে না। গাছ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে। মানুষ গাছ নয়।
তিনি অপেক্ষা করছেন টেলিফোন কলের জন্যে। রফিকের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি খবর পেয়েছেন, তারা হাজত থেকে ছাড়া পেয়েছে। তিনি কথা বলতে চান মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। ব্যবস্থা করা হয়েছে।
টেলিফোন বাজছে।
তিনি রিসিভার কানে ধরলেন। মৃদু গলায় বললেন, কে কথা বলছেন?
স্যার আমি–আমি মনিরুজ্জামান।
কী ব্যাপার? স্যার, আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি, আমি…
ঠিক আছে, আপনাকে ক্ষমা করা হলো—ঐ মেয়েটির যদি কোনোরকম সমস্যা হয়…
স্যার, কোনো সমস্যা হবে না।
গুড।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। মুন ইজ ডাউন বইটির শেষ পাতাটা পড়া বাকি ছিল। শেষ পাতা পড়লেন। বইটা তার ভালো লাগেনি। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো শেষ পাতায় নতুন কিছু বলা হবে। তাও না। বইটিতে এমন এক জগতের কথা বলা হয়েছে, যে জগতের অস্তিত্ত্ব আছে শুধুই কল্পনায়। বাস্তব পৃথিবী এমন নয়। বাস্তব পৃথিবীতে মনিরুজ্জামানরা বাস করে। শুভ্র এই সত্যটা কখন বুঝবে? যদি বুঝতে পারত তাহলে এই বইটি ডাস্টবিনে ফেলে দিত। তার নিজের সেরকমই ইচ্ছা হচ্ছে, কিন্তু শুভ্র বই তাকে দিয়েছে জন্মদিনের উপহার হিসেবে। অসম্ভব সুন্দর একটি বাক্য লিখে দিয়েছে। এত সুন্দর কথা লেখা একটা বই তিনি দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে শুভ্রর প্রসেসমেন্ট ঠিক নয়। তিনি আদর্শ মানুষ নন। একজন আদর্শ মানুষ কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে পারে না। আমাদের প্রফেট আদর্শ মানুষ ছিলেন। তাঁর ছিল দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা।