মোতালেব রানাকে সাহায্য করছে। বল্টু দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। বল্টুর মন খুব খারাপ। ট্রেনে ওঠার পর থেকে মুনা তার সঙ্গে একটা কথাও বলে নি। এর মানে সে বুঝতে পারছে না।
মুনার পুরো ব্যাপারটাই সবসময় তার কাছে এক ধরনের রহস্য। মেয়েটা তাকে পছন্দ করে, না করে না? তাকে সে একটা স্যুয়েটার কিনে দিয়েছে। ধরে নেয়া যেতে পারে, পছন্দ করে বলেই দিয়েছে। কিন্তু কথাবার্তায় কিংবা আচারআচরণে তার কোনো প্ৰমাণ নেই।
বল্টুর একবার ধারণা হয়েছিল, তার বড় ভাই উপস্থিত বলেই মুনা তার সঙ্গে কথা বলছে না। মেয়েরা আড়াল পছন্দ করে। কিন্তু সঞ্জু তো কাল রাতেই চলে গেছে। এর পরেও মুনা কথা বলবে না কেন? বল্টু নিজ থেকে উদ্যোগ নিয়ে আজ ভোরবেলা কথা বলার চেষ্টা করেছে। মুনাকে গিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বলেছে–মুনা, চা খেতে যাবি? একটা দোকানে দেখলাম গুড়ের চা বানাচ্ছে।
মুনা বলল, গুড়ের চা খাবার জন্যে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে আছি আপনাকে কে বলল? চিনির চা-ই খাই না, তো গুড়ের চা।
চা না খেলে না খাবি-চিল, হেঁটে আসি।
আপনার সঙ্গে হাঁটতে যাব?
হ্যাঁ। অসুবিধা আছে?
অবশ্যই অসুবিধা আছে। বাঁটকু লোকের সঙ্গে আমি হাঁটি না। লোকজন দেখে ফিক ফিক করে হাসে। তারা মনে মনে বলে-লম্বা মেয়েটা এই বাঁটকুটার সঙ্গে হাঁটছে কেন?
বল্টুর মন এই কথায় অত্যন্ত খারাপ হলো। এই জাতীয় কথা কি কেউ বলতে পারে? বলতে পারা কি উচিত? মুনার দেয়া স্যুয়েটার সে এখন পরে আছে। ইচ্ছা! করছে স্যুয়েটারটা খুলে টেকনাফের নদীতে ফেলে দিতে। দরকার নেই শালার স্যুয়েটারের!
রানা বিরক্ত গলায় বলল, তোরা সব হাবার মতো তীরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমাদের কি রওনা দেয়া লাগবে না? জোয়ার-ভাটার ব্যাপার আছে। যাকে বলে সমুদ্রযাত্রা। এক্ষুনি রওনা দিতে হবে। নো ডিলে।
নীরা নিচু গলায় বলল, আমি যাচ্ছি না।
রানা হতভম্ব হয়ে বলল, আমি যাচ্ছি না মানে?
আমি সাঁতার জানি না।
আমরা তো সাঁতরে যাচ্ছি না। নৌকায় কয়ে যাচ্ছি।
আমার ভয় লাগছে। আমি যাব না।
রানা অনেক কস্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় বলার চেষ্টা করল–ঢেউ যা একটু নদীতেই দেখা যাচ্ছে–নৌকা সমুদ্রে পড়লেই সব শান্ত। তাই না মাঝি?
মাঝি হাসিমুখে বলল, উল্টা কথা ন-কাইও। সাগরে ডাঙ্গর ডাঙ্গর গইর ঢেউ। তুঁই ন-জানো?
নীরা বলল, অসম্ভব, আমি যাব না। আমাকে বঁটি দিয়ে কুচিকুচি করে কেটে ফেললেও যাব না।
আনুশকা বলল, শোন নীরা, তীৰ্থস্থানে সবার যাবার সৌভাগ্য হয় না। অনেকেই খুব কাছ থেকে ফিরে যায়….
নীরা আনুশকাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, স্যারি, এক সময় আমি এরকম কথা বলেছিলাম। আমি সবার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি যাব না। প্লিজ, না।
নীরার গলায় এমন কিছু ছিল যে সবাই বুঝল নীরা যাবে না। কেউ কিছু বলল না। দীর্ঘ সময় সবাই চুপচাপ। রানার চোখে পলক পর্যন্ত পড়ছে না।
জরী বলল, নীরা, সত্যি যাবে না?
না জরী। আমি যাব না। নৌকায় উঠলেই আমি ভয়ে মরে যাব। আমি পানি অসম্ভব ভয় পাই। তোদের সঙ্গে ঠিক করেছি। কিন্তু আসল কথাটাই কখনো মনে আসে নি।
মুনা বলল, তাহলে কী হবে?
আমাকে নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে হবে না। আমি একটা বাস ধরে কক্সবাজার চলে যাব। সেখান থেকে ঢাকা।
আনুশকা বলল, এটা একটা কথা হল?
আমি যা করছি খুব অন্যায় করছি। আমি সেটা জানি।
ভয়কে জয় করতে হয় নীরা।
সব ভয় জয় করা যায় না।
রানা বলল, এখন তাহলে কী করা? নীরাকে একা একা যেতে দেয়া যায় না। একজন-কাউকে নীরার সঙ্গে যেতে হবে। কে যাবে?
বল্টু বলল, আমি। আমি নিয়ে যাব।
মুনা অবাক হয়ে বল্টুর য় আছে। কী বলছে এই মানুষটা? সে কি মুনার ওপর রাগ করে বলছে? এত রাগ কেন? মুনার সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল। তার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করল—অয়ন ভাই, আপনি যাবেন না। প্লিজ, প্লিজ। আমি নিতান্তই দরিদ্র পরিবারের একটা মেয়ে। আপনিও হতদরিদ্র একজন মানুষ। কোনোদিন যে আবার আমরা সমুদ্রের কাছে আসতে পারব—আমার মনে হয় না। কী সুন্দর একটা সুযোগ্য! আমার ওপর রাগ করে আপনি এই সুযোগটা নষ্ট করবেন। না। আমি জানি, আমি নানাভাবে আপনাকে কষ্ট দিই। আপনাকে আহত করি। কেন করি আমি নিজেও জানি না। প্রতিবার কষ্ট পেয়ে আপনি যখন মুখ কালো করেন তখন আমার ইচ্ছা করে খুব উচু একটা বিল্ডিং-এ উঠে সেখান থেকে লাফিয়ে রাস্তার পড়ে যেতে। অয়ন ভাই, বলুন তো আমার স্বভাবটা উলটো হলো কেন? কেন আমি আর দশটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক হলাম না? আমার ধারণা, আমি খুব বাজে ধরনের একটা মেয়ে। আপনার এই ধারণা সত্যি নয়। খুব ভুল ধারণা। আমি যে কত ভালো একটা মেয়ে সে জানে শুধু আমার মা। একদিন আপনিও জানবেন। সেই দিনটির জন্যে আমি কত যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি! অয়ন ভাই, আমাদের আর্থিক অবস্থাটা যে কত খারাপ সেটা তো আপনি জানেন—তার পরেও মার সংসার-খরচের টাকা চুরি করে আপনার জন্যে একটা স্যুয়েটার কিনলাম। আপনার একটাই স্যুয়েটার। সেটাও অনেকখানি ছেড়া। ছেড়া ঢাকার জন্যে আপনি সবসময় স্যুয়েটারের উপর একটা শার্ট পরেন। একদিন আমাকে বললেন-মানুষ কেন যে শার্টের উপর স্যুয়েটার পরে আমি জানি না। কী বিশ্ৰী লাগে দেখতে! মনে হয় শার্টের উপর একটা ভারি গেঞ্জি পরে আছে।
আপনার কথা শুনে আমি সেদিন কী কষ্ট যে পেয়েছিলাম! সারা রাত কেঁদেছি আর বলেছি, কেন একজন মানুষ আপনার মতো দরিদ্র হয়—আর কেন আরেকজন হয় শুভ্ৰ ভাইয়ার মতো ধনী?