না।
না কেন?
আমি তোমাকে বিপদে ফেলি নি, কাজেই বিপদ থেকে তোমাকে টেনে তোলার দায়িত্বও আমার নয়। তুমি স্বাধীনতা চেয়েছ, তোমাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে রওনা হয়েছ। এখন তুমি হুট করে আমার সাহায্য চাইতে পারো না।
শুভ্ৰ চুপ করে রইল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, তা ছাড়া আমি সারা জীবন বেঁচে থাকব না। এ জীবনে আমি যা সঞ্চয় করেছি সেইসব রক্ষার দায়িত্ব তোমার। আজ যদি এই সামান্য বিপদ থেকে নিজের চেষ্টায় বের হতে না পারো, তাহলে ভবিষ্যতে বড় বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে কী করে? বুঝতে পারছি আমি কী বলছি?
পারছি।
যখন কোনো সমস্যা আসবে তখন সমস্যাটাকে একটা বস্তুর মতো তোমার সামনের টেবিলে রাখবে। নানান দিক থেকে সমস্যাটা দেখবে। এক সময় লক্ষ করবে সমস্যাটির একটা দুর্বল দিক আছে। তুমি আক্রমণ করবে দুর্বল দিকে।
আমার সমস্যার দুর্বল দিক কোনটা বাবা?
যে লোক সমস্যা তৈরি করেছে, মেয়েটির হাসবেন্ড বলে যে নিজেকে দাবি করছে সেই সবচে দুর্বল। সে দুর্গ তৈরি করেছে মিথ্যার উপর। এ জাতীয় লোকেরা ভীতু প্রকৃতির হয়। এদের ভয় দেখালে এরা অসম্ভব ভয় পায়। এদের ভয় দেখাতে হয়। ছোটখাটো ভয় না। বড় ধরনের ভয়।
ভয় কীভাবে দেখাব?
সেটা তুমি জানো কীভাবে ভয় দেখাবে।
আমি ভয় দেখালেই সে ভয় পাবে কেন?
তুমি ভয় দেখালে সে ভয় পাবে, যদি সে জানে তুমি কে। তোমার ক্ষমতা কী?
বাবা, আমার তো কোনো ক্ষমতা নেই।
তোমার ক্ষমতা হচ্ছে, তোমার অর্থ! তোমার সঙ্গে চেকবই আছে না?
জি, আছে।
তুমি যদি চেকবই বের করে এক কোটি টাকার একটা চেক লিখে দাও, সেই চেক ফেরত আসবে না। ব্যাংক সেই চেক অনার করবে। এইখানেই তোমার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা দিয়ে তুমি যে কোনো মানুষকে ভয় দেখাতে পারো।
কিন্তু বাবা, এই ক্ষমতা তো মিথ্যা ক্ষমতা। হ্যাঁ, এই ক্ষমতা মিথ্যা। কোনো ক্ষমতাবান লোকই এই ব্যাপারটা জানে না। Thats the thing about you. শুভ্র অনেকক্ষণ কথা হলো, এখন টেলিফোন রাখি?
তুমি আর কিছু বলবে না বাবা?
হ্যাঁ বলব। I love you my son. এবং তুমি তোমার মুন ইজ ডাউন বইটিতে আমার সম্পর্কে যে উক্তি করেছ তা আমি পড়েছি। থ্যাংক য়্যু।
ইয়াজউদ্দিন টেলিফোন নামিয়ে রেখে হাতের বই খুললেন। প্রথম পাতায় শুভ্র সবুজ কালি দিয়ে লিখে রেখেছে
বাবা,
জন্মদিন শুভেচ্ছা।
আমার খুব ইচ্ছা করে আমি তোমার মতো হই।
শুভ্র।
ইয়াজউদ্দিন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললেন, শুভ্ৰ শুভ্রর মতোই থাকুক। ওকে আমার মতো হতে হবে না।
রাহেলা বললেন, তুমি টেলিফোন রেখে দিলে কেন? আমি শুভ্রের সঙ্গে কথা বলতাম।
স্যারি। আমি আবার যোগাযোগ করে দিচ্ছি।
না লাগবে না।
রাহেলার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখ মুছছেন।
ওসি সাহেব বললেন, শুভ্র সাহেব, আপনার টেলিফোনের কথা তো শেষ হয়েছে।
জি।
কী বললেন আপনার বাবা?
বাবা আমাকে মনিরুজ্জামান নামের ঐ লোকটার সঙ্গে কথা বলতে বললেন।
কথা বলবেন?
জি, কথা বলব।
উনি চলে এসেছেন। আমি ডেকে দিচ্ছি। আপনারা কথা বলুন। নিরিবিলি কথা বলুন।
ওসি সাহেব, আপনিও থাকতে পারেন।
মনিরুজ্জামান এসে বসল শুভ্রর সামনের চেয়ারে। মনিরুজ্জামানের পাশে বসেছে হারুনুর রশীদ। সে কৌতূহলী হয়ে শুভ্রকে দেখছে।
শুভ্র বলল, স্লামালেকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। আমি আপনাকে চিনতে পারি নি ভাই। আপনি ইয়াজউদ্দিন সাহেবের ছেলে। বাহ ভালো। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব আনন্দিত হয়েছি। ছিছি, এটা তো বিরাট লজ্জার ব্যাপার হয়ে গেল, ইয়াজউদ্দিন সাহেবের ছেলে কি-না হাজতে। ইয়াজউদ্দিন সাহেবের কাছে তো মুখ দেখাতে পারব না।
শুভ্র বলল, আপনি আমাদের এই ঝামেলা দূর করবেন, আশা করি।
অবশ্যই, অবশ্যই। আমি ওসি সাহেবকে বলে দিয়েছি। আপনাদের ওপর থেকে যত চার্জ ছিল সব তুলে নেয়া হয়েছে। আপনারা আপনাদের মতো বেড়াতে যাবেন। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যাব।
জরীও আমাদের সঙ্গে যাবে।
কী বললেন?
শুভ্ৰ শান্তমুখে বলল, আপনি যথেষ্ট যন্ত্রণা করেছেন। তার পরেও আপনাকে ক্ষমা করেছি। এরচে বেশি যন্ত্রণা করার চেষ্টা করলে ক্ষমা করব না।
কী করবেন?
আপনি জীবিত ঢাকা ফিরবেন না।
কী বললেন?
এই বাক্যটি আমি দ্বিতীয় বার বলব না। তবে যে বাক্যটি বলা হয়েছে—তা কার্যকর করার সমস্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এই তথ্যটা আপনার জানা থাকা দরকার।
শুভ্ৰ উঠে দাঁড়াল। মনিরুজ্জামান বলল, আরে বসেন, বসেন। রাগ করে উঠে যাচ্ছেন কেন? চা খান। ওসি সাহেব, আমাদের একটু চা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন না রে ভাই।
শুভ্ৰ বলল, আমি চা খাই না।
মনিরুজ্জামান হাত ধরে টেনে তাকে বসিয়ে ফেলল। হাসিমুখে বলল, আমাদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি থাকবে এটা কেমন কথা? আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে …
এখানে আলাপ-আলোচনার কিছু নেই।
আচ্ছা, না থাকলে নাই। চা তো খাওয়া যাবে। আমার সঙ্গে চা খেতে তো অসুবিধা নেই?
অসুবিধা আছে।
ওসি সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, শুভ্ৰ সাহেব, ঢাকা থেকে আপনার কাছে এক ভদ্রলোক এসেছেন। রফিক নাম। উনি থানার বাইরে অপেক্ষা করছেন। আপনি কি ওনার সঙ্গে কথা বলবেন?
শুভ্র বলল, ওনাকে অপেক্ষা করতে বলুন।
মনিরুজ্জামানের মুখ ছাইবৰ্ণ হয়ে গেল। সে পরপর দুবার টোক গিলল।
শুভ্ৰ দেখল তার বাবার কথাই ঠিক হয়েছে। ভয় কাজ করছে।
থানার সামনে পর্যটনের মাইক্রোবাস
থানার সামনে পর্যটনের এসি বসানো মাইক্রোবাস অপেক্ষা করছে। মাইক্রোবাসের পেছনে একটি পাজেরো গাড়ি। পাজেরোতে সুলেমান অপেক্ষা করছে। সে টেকনাফ পর্যন্ত যাবে। সুলেমানের সঙ্গে আরো দুজন। এই দুজনের চোখ ছোট ছোট, হাবভাব কেমন কেমন। এরা কখনো চোখে চোখে তাকায় না। কথা বলে মাটির দিকে তাকিয়ে। দুজনের গায়েই চামড়ার জ্যাকেট। থানার বারান্দায় রফিক সাহেবও হাঁটাহাটি করছেন।