দলের সবাই খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। সঞ্জু বলল, অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। শুভ্ৰ, তুই কি একটা কাজ করবি?
কী কাজ?
তুই তোর বাবাকে টেলিফোন করে ঘটনাটা বলবি? জরীকে একটা লোক জোর করে ধরে নিয়ে চলে যাবে-আর আমরা যাব দারুচিনি দ্বীপে। তা কী করে হয়?
শুভ্ৰ চুপ করে আছে। সঞ্জু বলল, কথা বলছিস না কেন?
বাবাকে কী বলব?
তোর কিছু বলতে হবে না। তোর বাবাই তোর ভেতর থেকে সব কথা টেনে বের করে নিয়ে আসবেন।
শুভ্ৰ অস্বস্তির সঙ্গে চুপ করে আছে। রানা রাগী ভঙ্গিতে বলল, তুই এমন স্টোন ফেস হয়ে গেলি কেন? বাবার সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা লাগছে?
শুভ্র বলল, বাবাকে কিছু বলার দরকার নেই।
বলার দরকার নেই কেন?
আমার ধারণা বাবা সবই জানেন।
গাধার মতো কথা বলবি না শুভ্ৰ। তোর বাবা কোনো পীর-ফকির না যে সব জানে। তোকে টেলিফোন করতে বলা হয়েছে, তুই টেলিফোন করবি এবং কাঁদো-কাঁদো গলায় বলবি, আমাদের রক্ষা করো। এস ও এস। বাঁচাও বাঁচাও।
এরা কি আমাদের টেলিফোন করতে দেবে?
এইটা একটা টেকনিক্যাল কথা বলেছিস। তোকে টেলিফোন করতে দেবে। কি-না সেটা হচ্ছে কথা। সম্ভবত দেবে না—তবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
বল্টু বলল, প্রয়োজনে আমি ওসি সাহেবের পা চেপে ধরব। অনেক ধরনের মানুষের পা ধরেছি, পুলিশের পা কখনো ধরি নি। পা ধরে সবচে বেশি মজা কখন পেয়েছিলাম জানিস? একবার এক পীর সাহেবের পা ধরেছিলাম-কী মোলায়েম পা! ধরলে ছাড়তে ইচ্ছা করে না।
শুভ্র ওসি সাহেবের সামনে বসে আছে। ওসি সাহেব টেলিফোন সেট তার দিকে বাড়িয়ে বললেন, নিন, টেলিফোন করুন।
শুভ্ৰ বিব্রত মুখে বলল, আমি নাম্বার ভুলে গেছি।
নাম্বার ভুলে গেছেন মানে? নিজের বাসার নাম্বার মনে নেই?
জি না। বাসায় তো কখনো টেলিফোন করা হয় না। তবে আমার হ্যান্ডব্যাগের পকেটে একটা ডায়েরি আছে—সেখানে নাম্বার লেখা আছে।
আচ্ছা, হ্যান্ডব্যাগ আনিয়ে দিচ্ছি। শুভ্র ডায়েরির জন্যে অপেক্ষা করছে। ওসি সাহেব কৌতূহল এবং আগ্রহ নিয়ে শুভ্ৰকে দেখছেন।
টেলিফোন ধরলেন শুভ্রর মা। শুভ্র বলল, মা, কেমন আছ?
রাহেলা প্ৰায় হাহাকার করে উঠলেন, তুই কেমন আছিস বাবা?
ভালো।
তোর চশমা! তোর চশমা আছে?
হুঁ, আছে।
খাওয়া-দাওয়ার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?
না, কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
বাইরের পানি খাচ্ছিস না তো?
উঁহু।
একসঙ্গে বেশি করে পানির বোতল কিনে নে।
আচ্ছা মা, নেব।
গত রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?
হুঁ।
এদিকে আমি সারারাত ঘুমুতে পারি নি। শুধু দুঃস্বপ্ন দেখেছি। শুভ্ৰ, তুই ভালো আছিস তো?
আমি ভালো আছি মা।
তোর বন্ধুরা? ওরা ভালো আছে তো?
হ্যাঁ, ওরাও ভালো আছে। আচ্ছা মা, বাবা কি অফিসে, না বাসায়?
তোর বাবা বাসায়। আজ কোথাও যায় নি। ওর শরীরটা নাকি ভালো না।
বাবা কী করছেন?
বিছানায় শুয়ে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছে। বই পড়ছে।
কী বই পড়ছেন মা?
কী বই পড়ছে তা তো দেখিনি—দেখে আসব?
না, তুমি বাবাকে দাও।
তুই আমার সঙ্গে আরেকটু কথা বল শুভ্ৰ। তারপর তোর বাবাকে দেব।
উঁহু, তুমি আগে বাবাকে দাও। তারপর আমি আবার তোমার সঙ্গে কথা বলি।
তুই কি আমাকে মিস করছিস শুভ্র?
হুঁ। মা, তুমি বাবাকে দাও।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব টেলিফোন-রিসিভার হাতে নিয়ে ভারি গলায় বললেন, হ্যালো।
শুভ্র বলল, বাবা, তুমি কী বই পড়ছ? তোমার হাতে এখন কী বই?
বইটার নাম হলো Moon is down.
শুভ্ৰ খুশি-খুশি গলায় বলল, তুমি আমার টেবিল থেকে বইটা নিয়েছ, তাই না?
হুঁ।
এটা তোমার জন্মদিনে দেবো বলে আনিয়ে রেখেছিলাম। প্যাকেট করা বই তুমি খুললে কেন? না বলে প্যাকেট খোলা তো নিষেধ।
মানুষের প্রকৃতি এমন যে সে সব সময় নিষেধ অমান্য করে।
বইটা তোমার কেমন লাগছে বাবা?
ভালো, খুব ভালো।
তোমার কি চোখে পানি এসেছে?
এখনো আসেনি।
পঞ্চাশ পৃষ্ঠার পর থেকে দেখবে—একটু পরপর চোখ ভিজে উঠেছে। তুমি ক পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়েছ?
কুড়ি-পঁচিশ পৃষ্ঠা হবে।
বাবা তোমার সঙ্গে আমার খুব জরুরি কয়েকটা কথা আছে।
এখন তুমি ছুটি কাটাতে গেছ, এখন আবার জরুরি কথা কী? এখন শুধু হালকা কথা বলবে।
কথাটা খুব জরুরি বাবা।
আমি তোমার কোনো জরুরি কথা শুনতে চাচ্ছি না।
বাবা, আমরা খুব বিপদে পড়েছি।
মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছ, বিপদে তো পড়বেই। বিপদে পড়বে, আবার বিপদ থেকে বের হয়ে আসবে। আবার পড়বে। দিস ইজ দ্য গেম।
পুলিশ আমাদের ধরে এনে হাজতে রেখে দিয়েছে।
ও, আচ্ছা।
আমাদের সঙ্গে জরী নামের যে মেয়েটি আছে—তার হাসবেন্ড এসেছে তাকে নিয়ে যেতে।
হাসবেন্ড নিয়ে যেতে চাইলে তো তোমরা কিছু করতে পারবে না। পুরুষশাসিত সমাজে স্বামীর অধিকার স্বীকৃত।
লোকটির সঙ্গে জরীর বিয়ে হয় নি। লোকটা মিথ্যা কথা বলছে। মিথ্যা কথা বলে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।
উল্টোটাও তো হতে পারে। হয়তো মেয়েটাই মিথ্যা বলছে। মেয়েরা পুরুষদের চেয়েও গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে। একজন পুরুষ যখন মিথ্যা কথা বলে তখন বোঝা যায়। সে মিথ্যা বলছে। কিন্তু একটা মেয়ে যখন মিথ্যা বলে তখন বোঝার কোনো উপায়ই নেই সে মিথ্যা বলছে।
তুমি খুবই অদ্ভুত কথা বলছ বাবা।
এটা আমার কথা না। যে বইটা এই মুহূর্তে আমি পড়ছি সেই বইয়ের নায়ক বলছে, তোর প্রিয় বই Moon is down-এ-ই এটা লেখা।
ঐ লোকটা একটা ফ্রড বাবা। ওর প্রতিটা কথাই মিথ্যা।
ও আচ্ছা।
বাবা শোনো—আমরা ভয়ংকর বিপদে পড়েছি। তুমি কি কিছু করতে পারো আমাদের জন্য?