আমি তার কোনো প্রয়োজন দেখছি না।
সারারাত জেগে থেকে পরদিন জার্নি করলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন স্যার। আপনার শরীর তো ভালো না।
যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি আপনি নিশ্চয়ই ডাক্তারের ব্যবস্থাও করে ফেলবেন। কাজেই আমি কোনো সমস্যা দেখছি না।
আপনি স্যার শুধু শুধু আমার ওপর রাগ করছেন। আমি হুকুমের চাকর।
আমি আপনার ওপর রাগ করছি না। তবে আবার যদি কখনো আপনাকে আমার পেছনে ঘুরঘুর করতে দেখি তাহলে রাগ করব। খুব রাগ করব। আপনার নাম কী?
স্যার, আমার নাম সুলেমান।
সুলেমান সাহেব, আপনি দয়া করে বিদায় হোন। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।
জি আচ্ছা, লাইটারটা রাখুন। স্যায়।
লাইটায় দিয়ে কী করব?
আপনার সিগারেট নিভে গেছে।
শুভ্র লাইটার হাতে নিজের জায়গায় ফিরে এলো। আনুশকা বলল, শুভ্ৰ, তুমি কি জরীকে দেখেছ? সে কোথায় জানো?
এখন কোথায় জানি না। তবে তাকে যেতে দেখেছি। হনহন করে যাচ্ছিল। একটা সুটকেসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে।
ও আমার ওপর রাগ করে। চলে গেছে।
কী নিয়ে রাগ করল?
কোনোকিছু নিয়ে না। রাগটা ওর মনে ছিল। বের হয়ে এসেছে। তুমি কি রাগ ভাঙিয়ে ওকে নিয়ে আসবে?
আমি গেলে ওর রাগ ভাঙবে?
হ্যাঁ, ভাঙবে।
শুভ্র জরীকে খুঁজতে বের হলো। আশ্চর্য কাণ্ড! জরী কোথাও নেই। একজন মানুষ তো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। কোথায় গেল সে? আখাউড়ায় ট্রেন কিছুক্ষণের জন্যে থেমেছিল। জরী কি তখন নেমে গেছে? শুভ্রর বুক কাঁপছে। সে আবার খুঁজতে শুরু করল।
স্যার, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?
না, কাউকে খুঁজছি না। আপনাকে না বলেছি আমার পেছনে ঘুরঘুর করবেন না?
সুলেমান এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। সে কি ছায়ার মতো শুভ্ৰকে অনুসরণ করছে?
সুলেমান ইতস্তত করে বলল, ভেজা শাড়িপরা মেয়েটি স্যার বুফেকারে আছে।
ও আচ্ছা, থ্যাংক য়্যু। আপনি কি সারাক্ষণই আমার পেছনে পেছনে আছেন?
আমি স্যার দূর থেকে লক্ষ রাখছি।
আমি কী করছি না করছি সব দেখছেন?
জি স্যার।
আমি যে বুফো কারের ম্যানেজারের গায়ে থুথু দিয়েছি, তাও দেখেছেন?
সুলেমান কিছু বলল না। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
শুভ্র একবার ভাবল বলে, এই ব্যাপারটা আপনি দয়া করে বাবাকে বলবেন না। তারপর মনে হলো, এটা বলা ঠিক হবে না। অন্যায় অনুরোধ। অন্যায় অনুরোধ আর যে-ই করুক, সে করতে পারে না।
বুফেকার অন্ধকার। টেবিলগুলির উপর বালিশ এবং চাদর বিছিয়ে বুফেকারের লোকজন শুয়ে আছে। একটি টেবিলই শুধু ছিল। তারই এক কোণায় জড়সড় হয়ে জরী বসে আছে। খোলা জানালায় বুষ্টির ছাট আসছে।
শুভ্র ডাকল, জরী।
জরী খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, এসো। বসো আমার সামনে।
একা একা কী করছ?
ভাবছি।
কী ভাবছ?
শৈশব থেকে ভাবা শুরু করেছি। চার বছর বয়স থেকে আরম্ভ করেছি, যেসব স্মৃতি মাথায় জমা আছে সেগুলি দেখার চেষ্টা করছি।
কোন পর্যন্ত এসেছ?
ক্লাস টেন। ক্লাস টেনে এসেই বাধা পড়ল। তুমি উদয় হলে।
শীত লাগছে না?
লাগছে। শীতে মরে যাচ্ছি। মনে হয়। জ্বরও এসেছে। দেখো তো গায়ে জ্বর আছে কি-না।
জরী হাত বাড়িয়ে দিল। কত সহজেই না সে তার হাত বাড়িয়েছে। দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। বরং একধরনের নির্ভরতা আছে।
শুভ্ৰ বলল, তোমার গায়ে জ্বর।
বেশি জ্বর?
হ্যাঁ, বেশি। অনেক জ্বর। তোমার বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক হয় নি।
বৃষ্টিতে না ভিজলেও আমার জ্বর আসত। আমি যখন বড় ধরনের কোনো সমস্যা থেকে মুক্তি পাই, তখন আমার জ্বর এসে যায়।
সেই জ্বর কতদিন থাকে?
সে হিসাব করি নি।
ভেজা কাপড় বদলাবে না?
বদলাতে পারলে ভালো হতো। নিজেকে অশুচি লাগছে, তবে নোংর বাথরুমে ঢুকে কাপড় বদলাতে ইচ্ছে করছে না।
তাহলে কী করবে? ভেজা কাপড়ে বসে থাকবে?
হ্যাঁ।
আনুশকা মন খারাপ করে আছে। তুমি নাকি তার সঙ্গে ঝগড়া করেছ?
জরী কিছু বলল না। জানালার অন্ধকারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জরী হাই তুলতে তুলতে বলল, প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। ইস, একটা পুরো কামরা যদি আমার একার থাকত, তাহলে দরজা বন্ধ করে হাত-পা ছড়িয়ে কী আরাম করে ঘুমুতাম!
শুভ্র ইতস্তত করে বলল, আমি একটা পুরো কামরার ব্যবস্থা করতে পারি। করব?
একটা পুরো কামরা শুধু আমার জন্যে?
হ্যাঁ।
কীভাবে করবে?
কীভাবে করব তা তোমার জানার দরকার নেই। করব কি-না সেটাই জানতে চাচ্ছি।
প্লিজ। শুভ্ৰ, করো। কীভাবে করবে?
ম্যাজিক। বড়লোকদের হাতে অনেক ধরনের ম্যাজিক থাকে।
শুভ্ৰ বুফেকারের বাইরে এসে দেখে, সুলেমান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। সুলেমান মনে হলো শুভ্ৰকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে। সে চলে যেতে চেয়েছিল, শুভ্র বলল, একটা কামরার ব্যবস্থা করুন।
সুলেমান হতভম্ব গলায় বলল, আপনাদের দুজনের জন্যে?
না, একজন শুধু যাবে। তার শরীর খারাপ।
ও আচ্ছা। আমি স্যার ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
ভয় পাবার কিছু নেই।
একজন ডাক্তারের ব্যবস্থা কি স্যার করব?
আপনি কি ডাক্তারও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন?
জি না স্যার। খুঁজে বের করব। এত বড় ট্রেন, একজন-না-একজন ডাক্তার তো থাকবেনই। ডাক্তার কি লাগবে স্যার?
না।
আমার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হবেন না স্যার।
শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে তাকাল। লোকটাকে এখন আর তার এত খারাপ লাগছে। না। কী রকম বিনীত ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে।
ট্রেন এসে চাটগাঁয়ে থামল
ট্রেন এসে চাটগাঁয়ে থামল ভোর পাঁচটায়। চারদিক অন্ধকার। ভোরের কোনো আভাস দেখা যাচ্ছে না। প্লাটফর্মের আলো কামরায় ঢুকছে। এই আলোটুকুই। ভরসা, কারণ, ট্রেন প্লাটফর্মে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেনের সব বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছে।