খুবই সাধারণ তত্ত্ব। দার্শনিক-ফার্শনিক না।
জরী, তুই কিন্তু ভিজে ন্যান্তা-ন্যাত হয়ে গেছিস। জরী হালকা গলায় বলল, তুই একটা প্রসঙ্গ নিয়ে এত কথা বলিস যে রাগ লাগে। কথা বলার তো আরো বিষয় আছে।
আচ্ছা যা, এই প্রসঙ্গে আর কথা বলব না; শুভ্ৰকে দেখছি না কেন রে জরী? শুভ্ৰ কোথায় গেল?
যাবে আবার কোথায়? ট্রেনেই আছে। মনে হয় এক কামরা থেকে আরেক কামরায় সিগারেট হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ওর এমন একা ঘুরে বেড়ানো ঠিক না। চোখে কম দেখে।
জরী হেসে ফেলল। আনুশকা বলল, হাসছিস কেন?
তোর মাতৃভাব দেখে হাসছি। তোর মধ্যে একটা দলপতি-দলপতি ব্যাপার আছে। সব সময় লক্ষ করেছি, আমরা কোথাও গেলেই তুই দলপতি সেজে ফেলিস; সব চিন্তা-ভাবনা নিজের মাথায়; আমাকে নিয়ে ভাবছিস, আবার শুভ্রকে নিয়ে ভাবছিস; এত কিসের ভাবাভাবি? আমরা সবাই রাজা।
আচ্ছা যা, আর ভাবব না।
না ভেবে তুই পারবি না। ব্যাপারটা রক্তের মধ্যে ঢুকে আছে।
আনুশকা বলল, জানালা পুরোটা খোলা না রেখে হাফ খুলে রাখ। তুই একেবারে গোসল করে ফেলেছিস।
জরী জানালা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। আনুশকা বলল, যাচ্ছিস কোথায়?
অন্য কোথাও গিয়ে বসব। যেখানে আমার মাতৃসম কেউ থাকবে না। কেউ আমাকে ক্ৰমাগত উপদেশ দেবে না।
স্যরি। এখানেই বোস। জানালা পুরোপুরি খুলে দে। আমি আর কিছু বলব না। ওয়ার্ড অব অনার।
না, তোর পাশে বসব না।
জরী হাঁটতে শুরু করল। দলের পুরুষদের মধ্যে শুধু মোতালেবকে দেখা যাচ্ছে। সে ইতোমধ্যে শোবার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। তার পাশের সিটের ভদ্রলোককে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দুটা সিটি দখল করে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছে। দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায় সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ কথা ছিল সারারাত কেউ ঘুমুবে না। জরীর মনে হলো—শেষটায় দেখা যাবে শুধু সে-ই জেগে আছে, আর সবাই ঘুমে। কামরায় গাড়িভরা ঘুম, রজনী নিঝুম।
রাত কত হয়েছে? জরীর হাতে ঘড়ি ছিল। এখন ঘড়ি নেই। কোথাও খুলেটুলে পড়ে গেছে। ভালোই হয়েছে। ঘড়িটা ঐ মানুষের দেয়া। দামি ঘড়ি। লোকটা কৃপণ না। সে তার স্ত্রীকে দামি-দামি জিনিসপত্র দিয়েই সাজিয়েছে। পরনের শাড়িটাও দামি। কত দাম জরী জানে না। লোকটার বোন এই শাড়ি তাকে পরাতে পরাতে বলেছিল, বেস্ট কোয়ালিটি, বালুচরি কাতান।
সেই বেষ্ট কোয়ালিটি বালুচরি। কাতান ভিজে এখন গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। জরীর এখন নিজেকে অশুচি লাগছে। মনে হচ্ছে ঐ লোকটা যেন তাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
একজন সাধারণ মেয়ের জীবনেও কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। জরী কি নিজেই সে এমন একটা কাণ্ড করতে পারবে? বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসবে?
যদি পালাতে না পারত তাহলে কী হতো? তাহলে এই রাতটা হতো তাদের বাসররাত। লোকটা তার শরীর নিয়ে কিছুক্ষণ ছানাছানি করে সিগারেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। আর সে সারারাত জেগে বৃষ্টি দেখত। আচ্ছা, ঢাকায় কি এখন বৃষ্টি হচ্ছে?
ঐ লোকটা কী করছে? ঘুমুতে নিশ্চয়ই পারছে না। কিংবা কে জানে মদ-ফদ খেয়ে হয়তো নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। তবে সেই ঘুম নিশ্চয়ই সুখের ঘুম না। নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
শুভ্ৰ লক্ষ করল, ভেজা শাড়ির এক অংশ চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে জরী হন-হন করে যাচ্ছে। তার একবার ইচ্ছা হলো জরীকে ডাকে। কিন্তু জরীর হাঁটার মধ্যে এমন এক আত্মমগ্ন ভঙ্গি যে, মনে হয় ডাকলেও সে থামবে না। একটা সুটকেসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে জরীর পড়ে যাবার মতো হলো। সে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসল। কার দিকে তাকিয়ে হাসল?
শুভ্রর হাতে একটা জুলন্ত সিগারেট। আজ এক রাতের মধ্যে অনেকগুলি সিগারেট খাওয়া হয়েছে। বমি-বমি লাগছে, বুক জ্বালা করছে এবং মাথা কেমন হালকা লাগছে। এই হালকা বোধ হওয়াটাই কি সিগারেটের নেশা? গাঁজা খেলে লজ্জা বাড়ে, ভাং-এর সরবত খেলে কী হয় এখনো জানা হয় নি।
স্যায়, একটু শুনবেন?
শুভ্র চমকে উঠে বলল, আমাকে বলছেন?
জি, আপনাকেই বলছি।
অপরিচিত একজন মানুষ। লম্বা, রোগী! মাথায় চুলের বংশও নেই। পরনে সাফারি। মেয়েলি গলার স্বয়। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা! এই লোককে আগে কখনো দেখেছে বলে শুভ্ৰ মনে করতে পারল মন।
আমি কি আপনাকে চিনি?
জি না স্যার।
আপনি আমাকে চেনেন?
ঞ্জি স্যার, চিনি। আপনার বাবা ইয়াজউদ্দিন সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন।
বুঝতে পারছি না। তিনি আপনাকে হঠাৎ করে কীভাবে পাঠাবেন?
আপনার দেখাশোনা করার জন্যে আমি ঢাকা থেকেই গাড়িতে উঠেছি।
শুভ্ৰ শুকনো গলায় বলল, ও আচ্ছা। তাহলে আপনি ঠিকমতই দেখাশোনা করে যাচ্ছেন? বাবাকে খবর পাঠাচ্ছেন কীভাবে, ওয়্যারলেসে?
স্যার, আপনি শুধু শুধু আমার ওপর রাগ করছেন?
আমি আপনার ওপর রাগ করছি না, রাগ করছি বাবার ওপর। আমি কল্পনাও করি নি বাবা একজন স্পাই পাঠাবেন।
স্যার, আপনি ভুল করছেন। আমি স্পাই না, আপনার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। সেজন্যই আমি যাচ্ছি। আমাকে বলা হয়েছে, বড় রকমের কোনো সমস্যায় পড়লেই শুধু আপনাকে আমার পরিচয় দিতে।
শুভ্ৰ মন-খারাপ করা গলায় বলল, আমি কি বড় রকমের কোনো সমস্যায় পড়েছি?
জি স্যার, পড়েছেন।
আমি তা কোনো সমস্যা দেখছি না।
আপনার ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে।
আমার ঘুমের অসুবিধা একটা বড় ধরনের সমস্যা। আপনি আমার ঘুমের ব্যবস্থা করেছেন?
জি। তিনটা এয়ার কন্ডিশান্ড কোচ আপনার নামে রিজার্ভ করা আছে। খালি যাচ্ছে। আপনারা ঘুমাতে পারেন।